বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
নিয়োগ সংক্রান্ত দু’টি মামলা সরিয়ে নেওয়া হল বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। গত কয়েক মাসে কোন খাতে জল গড়িয়েছে, তা ইতিমধ্যেই বহুচর্চিত, সে বিষয়ে আর কথা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বহুব্যবহারজীর্ণ প্রাচীনগন্ধী একটি উপমা দিয়ে বলা যেতে পারে, ‘সিজ়ারের পত্নী’কে যাবতীয় সংশয়ের ঊর্ধ্বে থাকতেই হবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষায় আদালতের ভূমিকা অতি তাৎপর্যপূর্ণ, এবং রাজনীতি ক্রমেই যে পাঁকে নিমজ্জিত হচ্ছে, তাতে বিচারবিভাগই একমাত্র ভরসা। বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অবকাশই নেই, কিন্তু শুধু নিরপেক্ষ থাকাই যথেষ্ট নয়— জনসমক্ষে সেই নিরপেক্ষতা প্রতীয়মান হওয়াও জরুরি। স্কুলে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন বক্তব্য, নির্দেশ এবং মন্তব্য জনসমাজের একটি বিরাট অংশের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছিল, মামলায় প্রশ্নাতীত ভাবে দ্রুততা এনে দিয়েছিল। অনেকে তাঁকে দুর্নীতির মহাপ্লাবনে ত্রাতার ভূমিকায় দেখে আশ্বস্ত বোধ করেছিলেন। অনেকে প্রত্যক্ষ ভাবে সে মত প্রকাশ করছিলেন। তবে নিস্পৃহ অবস্থানে স্থিত বিচারবিভাগের বিবেচনা ও বিচারের মধ্যেকার আশ্বাসটি আরও বড় মাপের। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে দৃশ্যত সেই কর্তব্যেরই অঙ্গীকার।
তবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাস থেকে দু’টি মামলা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের পর জনসাধারণের মধ্যে এক গভীর সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে যে, এর ফলে কি নিয়োগ সংক্রান্ত মামলার বিচারপ্রক্রিয়া গতি হারাবে। কেন এই সংশয়, বুঝতে অসুবিধা হয় না। দীর্ঘ কাল এই সমস্যাটির দিকে প্রশাসন কোনও নজর দেয়নি, এবং আদালতের চত্বরেও কোনও সুমীমাংসা হয়নি। গত কয়েক মাসেই নিয়োগ-মামলার বিস্তর অগ্রগতি হয়েছে, মানুষের মনে সুবিচারের আশা জাগ্রত হয়েছে। এ বিষয়ে বলার কথা একটিই। আজকের এই আশঙ্কার কারণ বুঝতে অসুবিধা না হলেও, বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জনসমাজের এ-হেন অনাস্থা প্রকাশ কিন্তু বিচারব্যবস্থার পক্ষে সম্মানজনক নয়। বরং বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা যাতে বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই দায়িত্ব গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানেরই উপর বর্তায়, বিচারবিভাগের সদস্যদের উপর তো বটেই।
নাগরিক সমাজকেও একটি কথা বুঝতে হবে। যাঁরা এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তাঁদের মনে রাখতে হবে যে— প্রশ্নটি কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের নয়, প্রশ্ন প্রতিষ্ঠানের। ভবিষ্যতে মামলাগুলি যে এজলাসেই যাক না কেন, সেগুলি একই প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত। একই মর্যাদা দাবি করে সমগ্র বিচার-প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি অংশ। বিচারপতিদের সকলেরই একান্ত দায়বদ্ধতা দেশের সংবিধানের প্রতি, এবং আইনের প্রতি। তাই, এক বিচারপতির পরিবর্তে অন্য কোনও বিচারপতি মামলাগুলি শুনলে বিচার ভিন্নতর হওয়ার কথা নয়। বাস্তবিক এমন আশঙ্কা প্রকাশের মধ্যে ভারতীয় বিচারবিভাগের প্রতি এক প্রবল অনাস্থা নিহিত রয়েছে। কেন সেই অনাস্থার পরিবেশ আজকের দেশে তৈরি হয়, বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু বিচারবিভাগ জনসমাজের সেই অনাস্থাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করবে, গণতন্ত্রকে সর্বার্থে সম্মান করে চলবে, এই আশাই পথ দেখাতে পারে। ভারত স্বভাবতই ব্যক্তিপূজার দেশ— এ দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে সেই প্রবণতা থেকে নিষ্কৃতি মিলবে, এমন আশা করা মুশকিল। কিন্তু অন্তত বিচারবিভাগের ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তি’-র পরিবর্তে ‘প্রতিষ্ঠান’-এর উপর বিশ্বাস বজায় রাখা অতীব জরুরি। বিচারপ্রক্রিয়া যে ভাবে এগোচ্ছিল, সে ভাবেই যেন এগোয়। যাঁদের প্রতি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তাঁরা যেন সকলে সুষ্ঠু ভাবে ন্যায়বিচার পান, সকল অপরাধী যেন শাস্তি লাভ করেন। প্রতিষ্ঠানের জোরের উপরে ভরসা রেখে সমগ্র সমাজের পক্ষ থেকে এই দাবি রইল।