আনন্দ-আবহে চিন্তার ভাঁজ।
দুর্গাপূজা এসে গেল, আনন্দ-আবহে চিন্তার ভাঁজও— কারণ, মহানগরের যান নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি। কলকাতার পুলিশ কমিশনার পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, কমিটি সদস্যরা সেখানে ব্যক্ত করেছেন নানা আশঙ্কা: রাস্তা ঠিক নেই, বহু রাস্তার মেরামতি সংস্কারকাজ হয়নি বা শেষ হয়নি ইত্যাদি। কলকাতার বহু বড় পুজোমণ্ডপ উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রধান সড়কগুলির সংলগ্ন, প্রতি বার পুজোয় সেগুলি ও শাখাপথগুলি জনস্রোতে রুদ্ধ হয়ে যান-চলাচলের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। দু’বছরের কোভিড-ভয় শেষে এবং ইউনেস্কোর স্বীকৃতির আবহে এ বছর আরও বেশি ভিড়ের সম্ভাবনা, এই অবস্থায় পুজোর শহর সুগম স্বাভাবিক রাখার পূর্বশর্তই হল রাস্তা ঠিক থাকা, এবং উৎসবের শহরে শক্ত হাতে যান নিয়ন্ত্রণ।
পুলিশ কমিশনার ভরসা দিয়েছেন সব ঠিক থাকবে, পুলিশ ও বিশেষত ট্র্যাফিক পুলিশ বিশেষ পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু তাতে সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না, কারণ যান নিয়ন্ত্রণ যদি বা পুলিশ করতে পারে, শহরের পথ-স্বাস্থ্য তাদের হাতে নয়— কলকাতা পুরসভা, বন্দর ও অনেকাংশে রাজ্য সরকারের অন্য দফতরেরও অধীন তা। তথ্য বলছে, গত এগারো বছরে রাস্তা খাতে পুরসভার বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ১৪১ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তব বলছে, বর্ষা আসতেই প্রতি বছর শহরের রাস্তার যে চেহারা বেরিয়ে পড়ে তার ব্যতিক্রম হয়নি এ বারেও, পুজো এগিয়ে আসতে পুরসভার এবড়োখেবড়ো বা খানাখন্দ-ভরা রাস্তায় জোড়াতালি সংস্কারের কাজই চোখে পড়ছে, যা কখনওই স্থায়ী সমাধান নয়, হতেও পারে না। এর ফলে অস্বচ্ছন্দ শহরপথে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে, দুর্ঘটনার পরে কোন রাস্তা কার অধীনে সেই নিয়েই চলে কিছু দিনের চাপানউতোর ও দায় ঠেলাঠেলি, ফল ভুগতে হয় নাগরিককেই। রাস্তা দেখাশোনা পুলিশের কাজ নয়, রাস্তায় নাগরিকের যাতায়াতের সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাদের কাজ। অথচ পুরসভা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও গাফিলতির জেরে অঘটন ঘটলে তার প্রত্যক্ষ আঁচ লাগে পুলিশের গায়েই। পুরসভা তা জানে বিলক্ষণ, তবু পথস্বাস্থ্যের হাল ফেরে না, এমনকি উৎসব সময়েও।
উৎসবের শহরে যান এবং বিশেষত তার গতি নিয়ন্ত্রণে সতত নজরদারি পুলিশের কাজ, সেও কি এ শহরে ঠিকমতো হয়? রাতভর ভিড়ের পর সকালে ফাঁকা পথে তুমুল গতিতে গাড়ি ও বাইক ছুটতে দেখা যায় শহরে। এর প্রতিকারে প্রযুক্তি-পরিকাঠামোর ব্যবহার ব্যয়সাপেক্ষ ও জরুরি নিশ্চয়ই, আরও জরুরি এই পরিকাঠামো ও ট্র্যাফিক নিয়ম ঠিকমতো পালন হচ্ছে কি না তার নজরদারি, নিয়ম লঙ্ঘন হলে সেই লঙ্ঘনকারীদের ধরা এবং যথোচিত দণ্ডবিধান। শেষোক্ত ক্ষেত্রটিতে কলকাতা এখনও গয়ংগচ্ছ। পথচলতি সাধারণ ট্র্যাফিক নিয়ম ভঙ্গে জরিমানার ক্ষেত্রে পুলিশ এখন অনেক সক্রিয়— তার সঙ্গে তাৎক্ষণিক ভাবে অর্থদণ্ড তথা প্রাপ্তির যোগ আছে বলেই হয়তো— কিন্তু যে ঘটনাগুলিতে নিয়মভঙ্গকারীকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলি কাঠগড়া অবধি পৌঁছয় না, মিটমাট নিষ্পত্তি হয় পথে, কিংবা ঘুরপথে। শহরের রাস্তা, যান ও গতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে এই সমস্ত কিছুরই সম্পর্ক। পুরসভা, পুলিশ তথা রাজ্য সরকার এই দিকগুলিতে পদক্ষেপ না করলে উৎসবের কলকাতায় ‘যাত্রা নাস্তি’-ই ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াবে।