দত্তপুকুরের মোচপোল বাজি বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে বাড়ি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
খাগড়াগড়, নৈহাটি, এগরা, দত্তপুকুর— বৃত্ত কি সম্পূর্ণ হল? না কি এখনও আরও অনেক প্রাণের বলি হওয়া বাকি? রাজ্যে বেআইনি বাজি কারখানা এবং তার বিপদ নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু শব্দ খরচ করা হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠক কম হয়নি, পুলিশ-প্রশাসনও নাকি নিয়মিত নজর রাখে বলে শোনা যায়। অথচ, বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ বা মৃত্যুমিছিল বন্ধের লক্ষণ নেই। এগরা বিস্ফোরণে ১১ জনের মৃত্যুর পর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। নবান্ন থেকে নাকি নির্দেশ গিয়েছিল, রাজ্যের সমস্ত বেআইনি বাজি কারখানার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার এবং বেআইনি বাজি কারখানার কর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে স্থানীয় থানাকে সতর্ক থাকার কথাও বলা হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও দত্তপুকুর কাণ্ড রোখা গেল না কেন? প্রশ্ন জাগে, মুখ্যমন্ত্রীর আদেশ মান্য করা হয় না, সে দায় কার— মন্ত্রীর? নেতার? বড় পুলিশকর্তার? না ছোট পুলিশকর্মীর? এই শেষ ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশকর্মীদের প্রতি কঠোর ভর্ৎসনা ধাবিত হয়েছে। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর আজ দরকার: সত্যিই কি ‘বড়’দের সদিচ্ছা থাকলে ‘ছোট’দের দিয়ে এ কাজ করানো এতটাই কঠিন হত? কর্মীদের কি সত্যিই এত সাহস আছে যে, তাঁরা কর্তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্যায়কারীদের প্রশ্রয় দেবেন? না কি এই শাসন, ভর্ৎসনা, সবই শেষ অবধি লোকদেখানো? রাজ্যের অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই বাজি-দুর্নীতির শিকড় এতই গভীরে যে, প্রশাসনের তরফে তার নিরাময় আশা করাই ভুল?
সে দিক দিয়ে দেখলে, গত রবিবারের সকালে দত্তপুকুরে যা ঘটল, তাকে আর নিছক ‘দুর্ঘটনা’ বলা চলে না। পরিণতি বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেই তাকে ঘটতে দেওয়া হয়েছে। এবং এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দায় ‘কম নয়’ বলাটা যথেষ্ট নয়, বস্তুত পুরোটাই প্রশাসনের দায়। পুলিশের কথাই ধরা যাক। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাজি কারখানা স্থাপন-সহ সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করে কার্যত তাদের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে এই বাজি-সাম্রাজ্য। অথচ, কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে তেমন কোনও কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হয়নি। স্থানীয়রা বাজি তৈরির বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ জমা দিলে উল্টে অভিযোগকারীদেরই ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ কি নিচু স্তরের পুলিশকর্মীদের যথেচ্ছাচার বলে মেনে নেওয়া সম্ভব? নাগরিক সমাজকে কি এতই নির্বোধ ভাবে বর্তমান প্রশাসন? বেআইনি কারখানার বাজিবারুদ শুধুমাত্র উৎসবের দিনে নয়, গণতন্ত্রের উৎসবেও নির্বিচারে ব্যবহৃত হয় বলে শোনা যায়। পুলিশ-প্রশাসনের উঁচু মহলের নীরব প্রশ্রয় কি সেই জন্যই? অঘটন ঘটলে নিয়মমাফিক প্রশাসনের আশ্বাস, কিছু দিন বেআইনি বাজি উদ্ধার, এবং ধরপাকড়ের প্রহসন। তার পর উত্তেজনা থিতিয়ে পড়লে ফের বারুদের কারবার যথা পূর্বম্। এই কুনাট্যই সযত্নে রচিত হয়ে চলছে এই রাজ্যে।
নাগরিক সমাজকে আর এক বার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, বেআইনি বাজি কারখানার সঙ্গে শুধুমাত্র মানুষের নিরাপত্তা নয়, পরিবেশের প্রশ্নটিও ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। বেআইনি বাজি তৈরির কারখানায় যে ধরনের রাসায়নিক এবং ধাতু ব্যবহার করা হয়, পরিবেশের উপর সেগুলির প্রভাব মারাত্মক। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনিক উদাসীনতায় সেগুলির অবাধ ব্যবহার হচ্ছে। এক দিকে সবুজ বাজি তৈরির ক্লাস্টারের কথা বলে মুখরক্ষার চেষ্টা করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, অন্য দিকে প্রশাসনের চোখের সামনে, সম্ভবত অবাধ প্রশ্রয়ে ও উৎসাহে চলেছে নিয়মভাঙার খেলা। রাজ্যকে এই ভাবে জতুগৃহে পরিণত করা থেকে নিবৃত্ত হোক প্রশাসন— এ কোনও অনুরোধ উপরোধ প্রস্তাব বা পরামর্শ নয়, অত্যন্ত জরুরি দাবি। নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা ও সুস্থতার স্বার্থে।