(বাঁ দিকে) মহিলা সংরক্ষণ বিলের উদযাপন এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। —ফাইল চিত্র।
মহিলা সংরক্ষণ বিল এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর ভারতবিরোধী অবস্থান— এই দুই ঘটনার মধ্যে এক বিরাট সাদৃশ্য আছে। দু’টি ঘটনাতেই দলমত নির্বিশেষে সংসদীয় নেতারা এক দিকে দাঁড়াতে পেরেছেন, যেটা সাম্প্রতিক ভারতে একটি অসম্ভব দুর্লভ ঘটনায় পরিণত। ট্রুডোকে দেখা হচ্ছে ভারতীয় রাষ্ট্রের অসম্মানকারী হিসাবে, ফলে সেখানে যে সকলে এককাট্টা হবেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু মহিলা সংরক্ষণ বিলের বিষয়টি একটু আলাদা। এতটা সর্বসম্মত ভাবে বিলটি পাশ হবে, সেটা আগে আন্দাজ করা যায়নি। কারণটি পরিষ্কার। এই বিল এই প্রথম ভারতীয় সংসদে উত্থাপিত হচ্ছে না। উনিশশো আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে বারংবার বিভিন্ন সরকার ও বিবিধ প্রধানমন্ত্রীর আমলে সংসদে হয় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কিংবা বিল পেশ হয়েছে, এবং প্রতি বারই প্রবল তর্কবিতর্ক আক্রমণ-প্রতিরোধে সেটি বাতিল হয়েছে। মনে করা যেতে পারে এক বার বাজপেয়ী সরকারের আমলে বিলটির প্রতিলিপি ছুড়ে ফেলেছিলেন কিছু নেতা— অবশ্যই তাঁরা বিহার ও উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি ছিলেন। এ বার ওবিসি প্রতিনিধিরা তত আক্রমণাত্মক হবেন না, বর্তমান বিজেপি সরকার তাঁদের যথেষ্ট রাজনৈতিক চাপে রাখতে সমর্থ হয়েছে, এ কথা জানা থাকা সত্ত্বেও যত বিতর্কহীন ভাবে, প্রায় সর্বসম্মতিতে বিলটি পাশ হল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর— এবং গণতন্ত্রের পক্ষে বেশ ক্ষতিকর বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ক্ষতিকর, কেননা মহিলা সংরক্ষণ বিলের পরিপ্রেক্ষিতে যে সমালোচনাটি বার বার উঠে আসছিল, সেটি যথেষ্ট গুরুতর। এবং প্রাসঙ্গিক। নিকট বা দূর ভবিষ্যতে যে তা একটা বড় সমস্যা হিসাবে দেখা দেবে, পিছিয়ে পড়া সমাজের মহিলারা যদি সামগ্রিক মহিলা সংরক্ষণের মধ্যে কতখানি জায়গা নিতে পারেন তার সমাধান ছাড়া সংরক্ষণ যে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, এ নিয়ে সন্দেহ চলে না। সুতরাং সংসদীয় বৈঠকে তার খোলামেলা আলোচনা, তর্কাতর্কি প্রয়োজনীয় ছিল। ভারতের মতো বহুসমাজী দেশে এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে যদি কোনও বিল পাশ হয়, তা হলে বুঝে নিতে হয় স্বাভাবিক গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করার অস্বাভাবিক কোনও প্রয়াস ঘটছে। ফলত রাহুল গান্ধী-সহ কংগ্রেস নেতারা যে ভাবে পরে জোর দিয়ে বলেছেন যে ওবিসি প্রশ্নে সংরক্ষণের মধ্যে সংরক্ষণের বিষয়টিকে বাদ দিয়ে বিলটি অসম্পূর্ণ। কথাটা হল, এই প্রশ্ন তাঁরা জোরালো ভাবে সংসদে তুললেন না কেন? ভয় পেলেন, তাঁদের ‘নারী-অধিকার বিরোধী’ দেখাতে পারে ভেবে? ভয়টি হয়তো অকারণ নয়, তবে দুর্ভাগ্যজনক বটেই। বাস্তবিক, ডিলিমিটেশন কিংবা জাতগণনা, যে দু’টি সংস্কারের জন্য এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অপেক্ষার কথা বলছে বিজেপি সরকার, তার কোনওটিই আসলে জরুরি ছিল না, প্রকৃত জরুরি বিষয় ছিল এই সামগ্রিক বনাম পশ্চাৎপদ সমাজের প্রশ্নটির বিবেচনা।
এরই মধ্যে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের নতুন রাজনৈতিক পদক্ষেপ, মতান্তরে, রাজনৈতিক ‘চাল’ অর্থাৎ জাতগণনা এসে গিয়ে বিষয়টি আরও জটিল করে দিল। অন্তত রাজনৈতিক প্রচারের স্তরে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে এ বার এই নতুন সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে, এমনটা ধরেই নেওয়া যায়। সাধারণ ভাবে ৩৩ শতাংশ মহিলাদের আসন সংরক্ষণ এবং ওবিসি আসন সংরক্ষণের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার অঙ্কটি পরিষ্কার না হলে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে অনেক অস্পষ্টতা থেকে যায়। বিশেষত বিহারের মতো রাজ্যে যেখানে ওবিসি এবং ইবিসি (অত্যন্ত পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী) সংখ্যাগরিষ্ঠ— তাদের জন্য এই সংস্কার এবং সংস্কারের ধারাগুলির স্পষ্টতা অতীব প্রয়োজনীয়। ফলে বিরোধীদের সমালোচনাটিই সার সত্য— এই সব সূক্ষ্ম হিসাব ব্যতিরেকে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ করে মোদী সরকার কেবল একটি নির্বাচনী চমক তৈরি করল মাত্র। কাজের কাজ কিছুই হল না।