তামিলনাড়ুর মন্ত্রী উদয়নিধি স্ট্যালিন এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। —ফাইল চিত্র।
জাতীয় হিন্দি ভাষা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং তামিলনাড়ুর মন্ত্রী উদয়নিধি স্ট্যালিনের মধ্যে যে টুইট-দ্বৈরথ হল, তার পিছনে ৭৪ বছরের ইতিহাস রয়েছে। টানা তিন দিন বিতর্কের পরে ১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ভারতের আইনসভা হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষার আপেক্ষিক গুরুত্ব বিষয়ে একটি রফাসূত্রে পৌঁছয়— ভারতের সংবিধান আলোচনায় যা মুনশি-আয়েঙ্গার সূত্র হিসাবে পরিচিত। তাতে স্থির হয়, হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা হিসাবে বিবেচিত হবে— স্মরণে রাখা ভাল যে, জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা নয়, সরকারি কাজের ভাষা— এবং, পরবর্তী পনেরো বছর ইংরেজিও সরকারি কাজের ভাষা হিসাবে সমান গুরুত্ব পাবে। পনেরো বছর পরে সংসদে সিদ্ধান্ত হয় যে, পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া অবধি কাজের ভাষা হিসাবে ইংরেজিও বহাল থাকবে। দেশের দু’টি সরকারি কাজের ভাষার মধ্যে একটি হিসাবে স্বীকৃত হওয়া কি আদৌ এত বড় কৃতিত্ব, যার জন্য দেশ জুড়ে একটি দিবস পালন করতে হয়? সে প্রশ্নের উত্তরও ইতিহাসেই আছে। ১৯৪৯ সালে আইসভায় যে বিতর্ক হয়েছিল, তার থেকে স্পষ্ট যে, হিন্দির আধিপত্য নিয়ে দু’টি শঙ্কা প্রবল ছিল। এক, হিন্দির আধিপত্য বৃদ্ধির অর্থ উর্দুবহুল হিন্দুস্থানি এবং উর্দু ভাষার গুরুত্ব হ্রাস— প্রকৃত প্রস্তাবে যা ভারতীয় রাষ্ট্রে মুসলমানদের গুরুত্ব হ্রাস হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। দ্বিতীয় আশঙ্কাটি ছিল মূলত দক্ষিণ ভারতের— যে অঞ্চলে হিন্দি ভাষার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। হিন্দির স্বীকৃতি ছিল ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের উপরে গাঙ্গেয় উত্তর ভারতের আধিপত্য স্থাপনের প্রতীক।
পৌনে শতাব্দী পেরিয়ে সেই দু’টি আশঙ্কার মধ্যে একটি— উর্দুর গুরুত্ব হ্রাস— তার তাৎপর্য হারিয়েছে। উর্দুর পরিসর সঙ্কীর্ণ হতে হতে লুপ্তপ্রায়, এবং এই গৈরিক জাতীয়তাবাদী শাসনে মুসলমানদের উদ্বেগের এত বড় বড় কারণ তৈরি হয়েছে যে, ভাষার প্রশ্নটি নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ আর কারও নেই। দক্ষিণ ভারতের আপত্তিটি পুরোমাত্রায় বহাল আছে। হিন্দি ভাষা দিবসই হোক বা জাতীয় শিক্ষানীতি, হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের যে কোনও কৌশলের প্রবলতম প্রতিবাদও দক্ষিণ ভারতেই ধ্বনিত হয়। কিন্তু, এই মুহূর্তে আরও একটি বিপদসঙ্কেত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার জন্য একটি প্রশ্নের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে— যে গৈরিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র মরাঠাভাষী মহারাষ্ট্রের নাগপুর, এবং যে দলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই নেতাই গুজরাত রাজ্যের নাগরিক, যে রাজ্যের রাজনীতিতে গুজরাতি অস্মিতার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত, সেই রাজনীতি কেন সর্বশক্তিতে হিন্দির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়?
তার একটি কারণ যদি সাভারকরের হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান’এর সূত্র ধরে একশৈলিক রাষ্ট্রগঠনের নীতি হয়, অন্য কারণটি হল, নরেন্দ্র মোদীর দশকব্যাপী শাসনের পরেও বিজেপি রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিন্দি বলয়। ওই অঞ্চলের ভাষা হিন্দি, কেবল এইটুকুই নয়, উল্লেখযোগ্য এই যে, ভারতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত এই বলয়ের অধিকাংশ মানুষ হিন্দি ব্যতীত অন্য কোনও ভাষায় ন্যূনতম দক্ষতাটুকুও অর্জন করতে পারেননি। ফলে, ভারতের কাজের বাজারের যে অংশটি বিশ্বায়িত অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত, তা বহুলাংশে এই জনগোষ্ঠীর আওতার বাইরে থেকে গিয়েছে। সরকারি কাজে হিন্দি ভাষার ব্যবহার বাড়িয়ে তুললে সেই কাজ যেমন এই জনগোষ্ঠীর নাগালে আসে, তেমনই অ-হিন্দিভাষী অঞ্চলের মানুষের পক্ষে সেই চাকরি দুঃসাধ্য হয়। হিন্দির গুরুত্ব যে আসলে এই বলয়টির আর্থিক লাভের কথা মাথায় রেখে, এই কথাটি প্রচারিত হলে কার রাজনৈতিক লাভ, বিজেপি সেই হিসাব বিলক্ষণ জানে। হিন্দি ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার রাজনীতির ভাঁজে থাকা এই অর্থনীতির চোরা যুক্তিটি ধরতে না পারলে সে রাজনীতি বোঝায় খামতি থেকে যাবে।