— ফাইল চিত্র।
এত দিন প্রাণে প্রাণে অনুভব করা যাচ্ছিল, কিন্তু মুখ ফুটে বলা হয়নি। সেই কাজটিই করল ভারতের শীর্ষ আদালত, গত ৬ এপ্রিলের এক পর্যবেক্ষণে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারতের পরিবেশ ও প্রকৃতিতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা থেকে সুরক্ষা এ দেশের নাগরিকদের এক মৌলিক ও মানবিক অধিকার। শুধু তা-ই নয়, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার অধিকারকে সংবিধানের প্রাণভ্রমরা ১৪ ও ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে যুক্ত করে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, পরিষ্কার ও সুস্থিত পরিবেশ না থাকলে জীবনের ও সাম্যের অধিকার পূর্ণতা পায় না। প্রতিটি নাগরিক তথা সাধারণ মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকার জন্য জলবায়ু বিপর্যয় থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা তাই রাষ্ট্রের কাজ।
এ নিঃসন্দেহে এক অতি জরুরি পর্যবেক্ষণ। জলবায়ু বিপর্যয়কে এই সময়ে জনজীবনবিচ্ছিন্ন, দূরবর্তী কোনও ঘটনা বলে মনে করাটা মূর্খের বিলাসিতা, অথচ দেশের সরকারকে তা মনে করিয়ে দিতে আদালতের প্রয়োজন পড়ছে। জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে ভারত সরকারের যে ভাবনা চোখে পড়ে তা যত বহিরঙ্গের আলোচনা, আনুষ্ঠানিকতা, আয়োজন-উচ্ছ্বাস ঘিরে, দেশের মানুষকে এই সঙ্কটের গভীরতা বোঝানো, আর উপযুক্ত অভিযান ও পদক্ষেপ করা নিয়ে তত নয়। বিশ্ব স্তরে জলবায়ু সঙ্কট সংক্রান্ত সম্মেলনে ভারতের উপস্থিতি যথেষ্ট, ‘প্রতিপত্তি’ও, কিন্তু দেশের মধ্যে এখনও পর্যন্ত জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলায় তার একক বা নির্দিষ্ট কোনও আইন নেই। এই অভাবের জায়গাটিকেই উল্লেখ করে শীর্ষ আদালতের মন্তব্য, আইন নেই মানেই এ হতে পারে না যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব থেকে সুরক্ষার অধিকার নাগরিকদের নেই। সোজা কথায়, নাগরিকের নিয়ন্তা হিসাবে সরকারের দায়িত্ব সর্বাবস্থায় তার অধিকার নিশ্চিত করা; অধিকার নিশ্চিত করতে আইনের দরকার, অতএব জলবায়ু বিপর্যয় থেকে নাগরিককে বাঁচাতে তাকে আইন করতে হবে, এবং আনুষঙ্গিক সব ব্যবস্থাও। যে সরকার তা করে না, সে অকর্মণ্য, ব্যর্থ।
জীবনের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, সর্বোপরি মানবাধিকারের সঙ্গে জলবায়ু বিপর্যয়ের মতো মহাসঙ্কটকে যুক্ত করে ভাবার এই দায়িত্বটি সবার আগে ছিল রাষ্ট্রের, সরকারের। কী ভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা বন্যা ঘূর্ণিঝড় শস্যহানি ইত্যাদির পরিণতিস্বরূপ নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য দাঁড়িয়ে আছে শারীরিক ও মানসিক রোগব্যাধি এমনকি মৃত্যুর মুখেও, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উচিত ছিল সে কথা সরকারের প্রধান ও নীতি-নিয়ামকদের বারংবার বলা, সেই নিয়ে পদক্ষেপ করতে প্রণোদনা দেওয়া। জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির সম্পর্কটিও গভীর, নাগরিকের স্বাস্থ্য ও জীবনহানি মানে শ্রম ও মানবসম্পদেরও ক্ষতি, আর তাতে ছায়া ঘনায় দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যেও। জলবায়ু সঙ্কটের কারণে কোনও অঞ্চলে খাদ্যাভাব বা জলাভাব দেখা দিলে সম্পন্ন নাগরিক গোষ্ঠীর তুলনায় সেখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ হবে অনেক বেশি— এ কথা বুঝতে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। অথচ এই কথাটিই রাষ্ট্র তথা সরকারকে বোঝাতে হচ্ছে সংবিধান উদ্ধৃত করে, আইনের অভাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে। ভারতের বিচারব্যবস্থা তো বটেই, অনেক নাগরিকও যা বুঝছেন, সরকার তা বুঝছে না, এ অতি দুর্ভাগ্যের।