দক্ষিণ ভারতে কর্নাটকই বিজেপির ঘাঁটি ছিল, সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে এ-হেন ভরাডুবি ঘটল কেন? ফাইল ছবি।
দক্ষিণ ভারতে কর্নাটকই বিজেপির ঘাঁটি ছিল, সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে এ-হেন ভরাডুবি ঘটল কেন? এই প্রশ্নে ঢোকার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আসনসংখ্যা অনেক কমলেও গত নির্বাচনের তুলনায় এই দফায় বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে। স্পষ্টতই, গত বারের তুলনায় এই নির্বাচনে বিজেপির জনসমর্থন কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে ঘনীভূত হয়েছে। অর্থাৎ, দলের ভরাডুবির আপাত কারণটি হল, সমগ্র রাজ্যে আর সমর্থনের সুষম বণ্টন নেই। এমন অবস্থা কেন, তার উত্তরে কিছু ব্যবহারিক কারণ আলোচিত হচ্ছে— যেমন দুর্নীতির বাহুল্য, দলের পুরনো নেতাদের গুরুত্ব হ্রাস ইত্যাদি। জগদীশ শেট্টারের মতো নেতাকে বাদ দেওয়ায় বিজেপির লিঙ্গায়েত ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব পড়ার কথা আলোচিত হচ্ছিল, কিন্তু ছ’বার জেতা আসনে শেট্টারের পরাজয় সেই তত্ত্বকে খানিক দুর্বল করেছে। এই কারণগুলি সবই কম-বেশি ঠিক, কিন্তু এই পরাজয়ের মূল কারণ সম্ভবত আরও গভীরে। এ রাজ্যে বিজেপি প্রথম ক্ষমতায় আসে ২০০৮ সালে। তার আগে এবং পরে, কর্নাটকে বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে মূলত উত্তর ভারতের বিজেপির ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান’ রাজনীতির স্পষ্ট এবং সচেতন ফারাক ছিল। অনস্বীকার্য যে, ২০০৮-এর সরকারের বিরুদ্ধেও সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু, কর্নাটকের বিজেপি রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল কন্নড় সংস্কৃতি, জাতীয়তা, স্থানীয় আর্থ-সামাজিক ও জাতিগত সমীকরণ। বাসবরাজ বোম্মাইয়ের বিজেপি সরকার সেই পরীক্ষিত পথ থেকে বিচ্যুত হল এই দফায়।
গত দু’বছরে কর্নাটকের রাজনীতি একাধিক বার আলোড়িত হয়েছে প্রত্যক্ষ ভাবে মুসলমান-স্বার্থবিরোধী প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। আজান ঘিরে বিতর্কই হোক, ইদগা হিসাবে ময়দান ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞাই হোক, হালাল মাংস বিক্রির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক রোষই হোক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব ব্যবহারের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা, অনগ্রসর মুসলমানদের জন্য কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত— কোনও ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত, এবং কোনও ক্ষেত্রে মেঠো রাজনীতির প্রতি প্রকট সরকারি সমর্থন, বোম্মাইয়ের সরকার সংশয়াতীত ভাবে এ রাজ্যে সর্বাপেক্ষা কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার কতখানি স্বতঃপ্রণোদিত, আর কতখানি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে দিল্লির উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতার ফল, সে তর্ক অন্যত্র। কিন্তু, বিজেপির রাজনীতি ক্রমশ উগ্র হিন্দুত্বের পথে প্রবাহিত হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে তাঁর প্রচারের কেন্দ্রে রেখেছিলেন হিন্দুত্বের প্রশ্নটিকেই— বজরংবলীর ‘অপমান’-এর প্রসঙ্গে টেনে এনেছিলেন কংগ্রেসের হাতে রামলালার বন্দি থাকার কথা। নির্বাচনের ফলাফল থেকে অনুমান করলে ভুল হবে না যে, সেই উত্তর ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকে কর্নাটক গ্রহণ করেনি।
সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যেতেই পারে, একটি জানা তথ্য এ বারের ভোটে পুনঃ-সমর্থিত হল— উত্তর ভারতীয় রাজনীতিকে দেশের অন্য প্রান্তের নাগরিকরা অন্য ভাবেও পাঠ করতে পারেন, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে। দুই দুগ্ধজাত পণ্য ব্যবসায়ী সংস্থাকে— একটি গুজরাতের আর অন্যটি কর্নাটকের— কেন্দ্র করে যে কন্নডিগা আবেগের বিস্ফোরণ ঘটল গত মাসে, তাতে স্পষ্ট যে, নাগরিকদের একাংশ সর্বভারতীয় বিজেপির রাজনীতিকে পাঠ করছেন হিন্দি বলয়ের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা হিসাবে। রাজ্যের ভাষা-সংস্কৃতির সম্পন্ন ঐতিহ্য যে জনসমাজের গর্বের জায়গা, তাদের উপর হিন্দি ভাষা চাপানোর প্রচেষ্টার সঙ্গেও যে আঞ্চলিক জাতীয়তা-র ভিন্ন ভিন্ন ধারার সংঘাত থাকতে পারে, মোদী-তত্ত্ব তা মানতে নারাজ। সেই তত্ত্বমতে, ‘এক দেশ’-এ সবই হবে একশৈলিক, একত্ববাদী। বিজেপির এই উত্তর ভারতীয় একবাদী অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করলেন কর্নাটকের নাগরিকরা— ভোটের ফলকে এই ভাবেও পাঠ করা সম্ভব।