ফাইল চিত্র।
আশঙ্কা সত্য বলিয়া প্রমাণিত। চরমে উঠিয়াছে বিশ্ব জুড়িয়া প্রতিষেধক-বৈষম্য। বস্তুত, পূর্বেই এমত বৈষম্যের আশঙ্কার কথা জানানো হইয়াছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ হইতে। বলা হইয়াছিল, প্রতিষেধক যাহাতে ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত না হইয়া থাকে, তাহা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করিতে হইবে। কিন্তু বাস্তব যে আদৌ সেই সাক্ষ্য দিতেছে না, সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব টেড্রস অ্যাডানাম গেব্রিয়েসাস স্বয়ং তাহা স্পষ্ট করিয়াছেন। যে দেশ অর্থের বিনিময়ে যত বেশি টিকার বরাত দিয়াছে, টিকার সিংহভাগ তাহারাই পাইয়াছে। বঞ্চিত হইতেছে দরিদ্র দেশগুলি। আমেরিকার ন্যায় বিত্তশালী দেশ টিকাকরণের নিরিখে বহু দূর অগ্রসর হইয়াছে। প্রাপ্তবয়স্কদের টিকাকরণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করিবার পর সেই সকল দেশে এখন শিশু, কিশোরদের টিকাকরণের আওতায় আনিবার কর্মসূচি শুরু হইয়াছে। কিন্তু মধ্য এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলির একাংশে এখনও প্রথম সারির কোভিড-যোদ্ধাদের টিকাকরণও সম্ভব হয় নাই। অথচ, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই এই সকল দেশে বাস করেন। অন্য দিকে, উচ্চ আয়ের দেশগুলিতে বসবাস করেন বিশ্বের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ। অথচ, মোট প্রতিষেধকের প্রায় ৪৫ শতাংশই এই দেশগুলির হাতে। গরিব দেশগুলিকে প্রতিষেধক-সাহায্য করিবার জন্য কোভ্যাক্স প্রকল্পের সূচনা করিয়াছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু সরবরাহে ঘাটতি এবং অর্থসাহায্য না থাকিবার কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলে নাই। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অবস্থা শোচনীয়। ফলে টিকা গ্রামীণ অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হইতেছে না।
ইহা বৈশ্বিক চিত্র। বৈষম্য কি দেশের অভ্যন্তরেও নাই? অবশ্যই আছে। ভারতে যেমন প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভেদরেখা প্রতীয়মান। কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গে গ্রামে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। পরিসংখ্যান বলিতেছে, দেশে প্রতি দশ জন সংক্রমিতের মধ্যে ছয় জনই গ্রাম অথবা মফস্সলের বাসিন্দা। অথচ, টিকাপ্রাপ্তদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ গ্রামে বাস করিয়া থাকেন। গ্রামগুলিতে সংক্রমণের বিস্তার রোধ করিতে যে পরিমাণ টিকা এবং প্রশিক্ষিত কর্মীর প্রয়োজন, তাহার ব্যবস্থা হইবে কী উপায়ে, কেন্দ্র স্পষ্ট করে নাই। এমনকি, বেসরকারি ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে প্রতিষেধক দানের ব্যবস্থা থাকিবার কারণে অর্থবানরা যে অনায়াস দ্রুততায় টিকা পাইয়াছেন, তাহা বিনামূল্যে টিকাপ্রাপকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় নাই।
এই বৈষম্য দুর্ভাগ্যজনক। জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির সুফল একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে আবদ্ধ থাকিলে তাহার মূল উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ হইতে বাধ্য। অতিমারিকে রুখিতে প্রতিটি মানুষকে টিকাকরণের আওতায় আনিবার প্রয়োজনীয়তা বহু আলোচিত। এমতাবস্থায় এই বৈষম্য অব্যাহত থাকিলে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা সামূহিক প্রতিরোধক্ষমতা গড়িয়া উঠিতে বহু বৎসর সময় লাগিবে। অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে সেই মূল্য চুকাইতে হইবে বিশ্বকে। সুতরাং, অবিলম্বে ভারসাম্য রক্ষার পথে হাঁটা প্রয়োজন। সম্প্রতি আমেরিকা ভারত-সহ বিভিন্ন দেশকে ৮ কোটি টিকা দিবার কথা ঘোষণা করিয়াছে। সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দিতে হইবে অন্য দেশগুলিকেও। অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই ঐক্যবদ্ধ লড়াই। কোনও একটি শ্রেণির হাত ধরিয়া ইহাতে সাফল্য লাভ অসম্ভব।