বিরোধী জোট। —ফাইল চিত্র।
ইন্ডিয়া নামক মঞ্চটির বয়স সদ্য একশো দিন অতিক্রম করেছে। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির এই সম্মিলনী সূচনাপর্বে রীতিমতো সাড়া জাগিয়েছিল— কেবল ‘শরিক’ দলের সংখ্যায় দ্রুত বৃদ্ধির কারণে নয়, একের পর এক বৈঠকে সমন্বয়ের সদর্থক বার্তাগুলি ক্রমশ জোরদার হয়ে ওঠার কারণেও। ইতস্তত বেসুর বেজেছিল শুরু থেকেই, মাঝে মাঝে বিবাদী স্বরও অশ্রুত থাকেনি। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে অগ্রগতির লক্ষণ ছিল স্পষ্ট। এই সমন্বিত প্রতিস্পর্ধার আঁচ পেয়ে শাসক বিজেপির অস্বস্তি যে ভাবে প্রকট হয়ে উঠছিল, তা কারও নজর এড়ায়নি। গত মাসের মধ্যপর্বে মুম্বইতে আপাতদৃষ্টিতে নির্বাচনী প্রস্তুতির সলতে পাকানোর কাজও শুরু হয় দু’টি লক্ষ্য নিয়ে— এক দিকে আসন বণ্টনের সূত্র নির্ধারণ এবং অন্য দিকে মধ্যপ্রদেশ-সহ নির্বাচনমুখী রাজ্যগুলিতে একে একে ইন্ডিয়া মঞ্চের সংগঠিত জনসভা আয়োজন। বিরোধী নেতাদের কারও কারও ভাষণে নবযুগের আগমনী শুনে দেশবাসী চমৎকৃত হয়েছিলেন।
অতঃপর শুরু হয় ভাটার টান, যা ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রদেশের জনসভা প্রস্তাবিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই প্রস্তাব প্রত্যাহৃত হয়। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়েও ইন্ডিয়া-র শরিকদের মনোমালিন্য এবং বিসংবাদ বেড়েই চলেছে। আম আদমি পার্টি রাজস্থান, ছত্তীসগঢ় এবং মধ্যপ্রদেশে প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, কংগ্রেসের সঙ্গে তার সম্পর্ক যথাপূর্বং তথা পরম্। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রধান সমস্যার কারণ বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে রাজ্যে, বিশেষত মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টির দ্বন্দ্ব। এই রাজ্যটিতে কংগ্রেস এসপিকে কার্যত সূচ্যগ্র জমি ছাড়তেও নারাজ। এবং প্রথম থেকেই সেই অবস্থান পরিষ্কার করে না জানিয়ে তারা অখিলেশ যাদবকে সর্বসমক্ষে অপদস্থ করেছে, এই অভিযোগকেও অযৌক্তিক বলা চলে না। তদুপরি রাজ্য কংগ্রেসের নেতারা তাঁর সঙ্গে প্রয়াত মুলায়ম সিংহ যাদবের সম্পর্কের কথা যে ভাবে হাটের মাঝে নিয়ে এসেছেন তা কেবল সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় নয়, ভয়ানক রকমের অশোভন। এসপি নেতা প্রত্যাশিত ভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, এমন জানলে তিনি বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও আলোচনাতেই যেতেন না। এক কথায়, বিধানসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়া-র সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই দূর অস্ত্।
প্রশ্ন হল, লোকসভা নির্বাচনে এই বিসংবাদের কতটা প্রভাব পড়বে? উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে জল এক বার ঘোলা হলে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার পরিচিত পরম্পরায় সেই ঘোলা জল যে অনেক দূর গড়াতে পারে, তার বিলক্ষণ সম্ভাবনা আছে। অখিলেশ যাদবের কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যে, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস যে ঢিলটি ছুড়েছে, উত্তরপ্রদেশে তার যোগ্য পাটকেলটি তিনি তৈরি করতে চলেছেন। এক রাজ্যের সংঘাত অন্য রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করলে লোকসভা নির্বাচনের আসন বণ্টনে ও সামগ্রিক সমন্বয়ের পথে কাঁটাগুলি সংখ্যায় এবং শক্তিতে আরও অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠতে পারে। আর এখানেই কংগ্রেসের মতো দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরের রাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে বিরোধ আছে ও থাকবে— এটাই ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব। কিন্তু রাজ্য স্তরের স্বার্থ যাতে সর্বভারতীয় স্বার্থকে প্রতিহত করতে না পারে, তার জন্য আরও অনেক বেশি কুশলী ও সংযত পদচারণার প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল দলের রাজ্য স্তরের নেতাদের পরিচিত হঠকারিতা ও দুর্বিনয়ের আতিশয্য দমন করার। এই প্রাথমিক কর্তব্য পালনে অপারগ হলে ‘হাই কমান্ড’ নামক বস্তুটির কোনও কার্যকর ভূমিকাই অবশিষ্ট থাকে না। বিধানসভা ভোটের পালা শেষ হওয়ার পরে নতুন করে ছেঁড়া তারগুলি জোড়া লাগানোর কাজ হয়তো শুরু হবে। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প— সেই সত্য কালজয়ী। তবে বিরোধী রাজনীতির ধারায় আপাতত ভাটার টানই কঠোর বাস্তব।