ব্রিকস সম্মেলনের মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতায় নরেন্দ্র মোদী ও শি জিনপিং। —রয়টার্স।
জি২০ সমাবেশের আগে ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমশই অধিকতর তিক্ততায় নিমজ্জিত হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে সাম্প্রতিক ব্রিকস সম্মেলনে সীমান্ত বিবাদ সংক্রান্ত পার্শ্ব বৈঠকের আহ্বান কোন তরফে প্রথম করা হয়েছিল, সেই নিয়ে শুরু হয় চাপানউতোর। শুধু তা-ই নয়, বৈঠকে দুই শীর্ষনেতার আলোচনার বিষয়েও পরে কোনও স্পষ্ট বিবৃতি মিলল না দুই তরফ থেকেই। কূটনীতিতে সাধারণত বিপক্ষের তুলনায় নিজেকে উচ্চতর দেখানো একটি পরিচিত রীতি। ভারত-চিনের ক্ষেত্রে এই রীতির মোক্ষম অনুশীলন টের পাওয়া যায়। গলওয়ান সংঘর্ষ নিয়ে দুই দেশ যে ভাবে তিন বছর পরেও নিজেদের শক্তি দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে— এই রীতিরই দৃষ্টান্ত। এ দিকে গলওয়ানের পর দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষত যে এখনও কত গভীর, দক্ষিণ আফ্রিকায় তা আরও এক বার প্রমাণিত হল। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের সীমান্ত বিবাদের পরে দুই শীর্ষনেতার মধ্যে এটি ছিল দ্বিতীয় বৈঠক। গত বছর নভেম্বরে বালিতে জি২০ সম্মেলনে দুই নেতার মধ্যে শুধু সৌহার্দ বিনিময় হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হলেও, সে সময় সীমান্ত সমস্যা নিয়েও যে আলোচনা হয়েছিল, তা স্বীকার করতে তাদের দীর্ঘ আট মাস লেগেছিল। এই মুহূর্তে ভারত সরকারের দাবি, সীমান্তে যত দিন না শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফিরছে, তত দিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব নয়— কিন্তু এই অবস্থান মোটেই ভাল চোখে দেখছে না বেজিং। তাদের বক্তব্য, রাজনৈতিক সংলাপ চলুক, কিন্তু দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পথে তা যেন কোনও বাধা না হয়।
এর মাঝে এসে গেল চিনের সরকারি ভাবে প্রকাশিত নতুন মানচিত্র যেখানে অরুণাচল প্রদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে আকসাই চিনও। মনে রাখতে হবে, ভারতের উত্তর সীমান্ত নিয়ে চিনের ক্রমাগত এই আগ্রাসী অবস্থানের মূল উদ্দেশ্য— ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিনের সঙ্গে আমেরিকা-সহ মিত্র দেশগুলির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা থেকে ভারতকে বিরত রাখা। ফলে ভারতের অংশ নিজেদের বলে দাবি করে ভারতকে উস্কানি দেওয়া এই অঞ্চলে চিনের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনারই একটি অঙ্গ। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নতুন মানচিত্রের বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন ‘আজগুবি দাবি’ হিসাবে। আর বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী এখনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতিক্রিয়া ও বক্তব্য দাবি করেছেন বিষয়টি নিয়ে।
বাস্তবিক, চিন-ভারত সম্পর্ক যতটা উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তাতে ঘরোয়া রাজনীতিতে এর প্রভাব বাড়তে চলেছে বলে আশঙ্কা করা যেতে পারে। শুধু বিরোধীদের সমালোচনার ঝড়ই আরও তীব্র হবে না, প্রভাব পড়বে আসন্ন কয়েকটি বিধানসভা ও পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনেও— এমন ভাবনায় উদ্বিগ্ন শাসক দল। এর মাঝে অরুণাচল প্রদেশ-সহ চিনের প্রকাশিত নতুন মানচিত্র নিয়ে ভারত যে ভাবে সরব হয়েছে, তাতে আসন্ন জি২০ সম্মেলনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো চিনের শীর্ষনেতাও যে এই বৈঠকে অনুপস্থিত থাকবেন, সে সম্ভাবনা প্রবল। ফলে জি২০-র প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়েও বিশ্বসমক্ষে নিজেকে মহিমান্বিত করার সুযোগ যে নরেন্দ্র মোদীর হাতছাড়া হতে চলেছে, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।