BJP

হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতা

রাম, হনুমান, গীতা, চণ্ডী ইত্যাদি ছেড়ে বিরোধীরা সেই লড়াইয়ে ফেরার সাহস যদি দেখাতে না পারেন, তবে গণতন্ত্রের মোড়ক খুলে হিন্দু রাষ্ট্রের মূর্তি উন্মোচনের বোধ করি আর বিশেষ দেরি নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৭
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

সঙ্ঘ পরিবার দিগ্বিজয়ের দাবি করতেই পারে। তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মোকাবিলায় নেমে বিরোধী শিবিরের বিভিন্ন মহল থেকে উত্তরোত্তর দিকে দিকে যে বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে তার সারমর্ম: তোমরাও হিন্দু, আমরাও হিন্দু। ব্রিগেডের মাঠে ২৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য উপস্থিতিতে এক শিবিরের সমবেত গীতাপাঠের আসর বসার আগেই অন্য শিবির থেকে সমবেত চণ্ডীপাঠ আয়োজনের কথা উঠেছে। ইতিমধ্যেই মাহেশে তাঁদের গীতাপাঠ ঘটে গিয়েছে রাজ্যের একাধিক মন্ত্রীর উপস্থিতিতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষার যা দশা হয়েছে, তাতে মন্ত্রী-সান্ত্রিরা স্কুলে স্কুলে শিশুদের সঙ্গে প্রথম ভাগ, সহজ পাঠ ইত্যাদি পড়তে বসলে পুণ্যলাভ হত, নিজেদেরও উপকার হত। কিন্তু রাজনীতির অঙ্ক আলাদা, সেই অঙ্কে এখন গীতা এবং চণ্ডীর বাজার গরম, হনুমান চালিসাই শ্রেষ্ঠ কাব্য। উত্তর ভারতের তথাকথিত গো-বলয়ে এই প্রবণতা বহুগুণ প্রবল। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বিরোধী কংগ্রেসের নেতানেত্রীরা প্রবল উদ্যমে হিন্দুত্বের অনুশীলন করেছেন, রামচন্দ্র থেকে হনুমান অবধি কিছুই বাকি রাখেননি, কমল নাথের রাজ্যে বজরং সেনা অবধি কংগ্রেসের সঙ্গে এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বে গোটা উত্তর ভারত জুড়েই এই লীলা দেখা যাবে, এমন লক্ষণ ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট।

Advertisement

অথচ নরেন্দ্র মোদী তথা সঙ্ঘের বিপরীতে রাজনৈতিক লড়াইয়ে কংগ্রেস সর্বভারতীয় স্তরে নিজেকে কেবল মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, প্রধান আদর্শগত প্রতিস্পর্ধী বলে দাবি করে। সেই দলের নেতা রাহুল গান্ধী বলে থাকেন, বিধানসভা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরেও বলেছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁদের আদর্শগত লড়াই জারি থাকবে। সেই আদর্শ কোথাকার কোন শমীবৃক্ষে লুকোনো আছে, এবং তা খায় না মাথায় মাখে, বুঝ লোক যে জান সন্ধান। ঘটনা হল, দীর্ঘ দিন ধরেই রাহুল গান্ধী এবং তাঁর সতীর্থরা একমনে ‘নরম হিন্দুত্ব’ নামক পিটুলিগোলা সেবন করে চলেছেন। দৃশ্যত, তাঁদের মনে সতত এই ভয় কাজ করছে যে, হিন্দুত্বের বিবিধ অভিজ্ঞান এবং সাজসরঞ্জামের ভজনা না করলে, এই মন্দির থেকে সেই মন্দিরে, এই দেবতা থেকে সেই দেবীর আরাধনা করে না বেড়ালে, হিন্দু ভারত আরও বেশি কুপিত হবে। অতএব তাঁরা প্রাণপণে ভোটদাতাদের বোঝাতে চাইছেন, নরেন্দ্র মোদীরা একাই হিন্দুত্বের উপাসক নন, তাঁরাও লাইনে আছেন। বঙ্গীয় শাসকরাও একই অঙ্ক কষে শীতের মরসুমে মাহেশ থেকে কলকাতা দৌড়াদৌড়ি করছেন।

অথচ অঙ্কটি আগাগোড়া ভুল। অতীতেও দেখা গিয়েছে, সদ্য-সম্পন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলির ফলাফলও আবার দেখিয়ে দিল, হিন্দুত্বের রাজনীতি করে বিজেপিকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। তত্ত্বেও নয়, বাস্তবেও নয়। ‘আদর্শগত প্রতিস্পর্ধা’ ফাঁকা কথার ব্যাপার নয়, তাকে বাস্তব রাজনীতিতে অনুশীলন করতে হয়। হিন্দুত্বের ধারণা এবং কার্যক্রমগুলিকে সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরে রাজনৈতিক অভিযানের কাজে লাগিয়ে এসেছে, সেই অভিযানের মধ্য দিয়েই সেগুলিকে ক্রমশ জোরদার করে তুলেছে এবং তার ভিত্তিতে সংখ্যাগুরু আধিপত্য নির্মাণ করেছে। কংগ্রেস হোক, তৃণমূল কংগ্রেস হোক, অন্য বিরোধী দল হোক, সকলকেই স্থির করতে হবে, তারা ওই সংখ্যাগুরুতন্ত্রের কাছেই নিজেদের বিকিয়ে দিতে চায়, না যথার্থ উদার, ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক আদর্শের পথে থাকতে চায়। প্রথম পথটি বেছে নিলে তারা আর ‘বিকল্প’ থাকবে না, সুতরাং ওই পথে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রকৃত মোকাবিলাও সম্ভব নয়। দ্বিতীয় পথটি সহজ নয়, কিন্তু সেটিই যথার্থ রাজনৈতিক লড়াইয়ের পথ। রাম, হনুমান, গীতা, চণ্ডী ইত্যাদি ছেড়ে বিরোধীরা সেই লড়াইয়ে ফেরার সাহস যদি দেখাতে না পারেন, তবে গণতন্ত্রের মোড়ক খুলে হিন্দু রাষ্ট্রের মূর্তি উন্মোচনের বোধ করি আর বিশেষ দেরি নেই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement