ব্রাত্য বসু। —ফাইল চিত্র।
শিক্ষা দফতর গ্রামের স্কুলে পড়ানো বাধ্যতামূলক করতে পারে, জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁর বক্তব্য, নিয়োগের আগেই অনেক শিক্ষক-পদপ্রার্থী গ্রামে যেতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। কর্মরত সরকারি শিক্ষকদের একটি বড় অংশ গ্রামের স্কুল থেকে বদলি নিয়ে শহরে আসতে ক্রমাগত তদবির চালাচ্ছেন। তাই শিক্ষকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশের সুযোগই তুলে দিতে চায় শিক্ষা দফতর। চাকরি জীবনের গোড়ার কয়েক বছর গ্রামে পড়াতে হবে, এই নীতি সরকার গ্রহণ করতে পারে, জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষক, চিকিৎসক তথা যে কোনও সরকারি কর্মচারীকে এ ভাবে ‘বাধ্য’ করার প্রবণতা কিছুটা অস্বস্তি জাগাতে বাধ্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকের ইচ্ছার মর্যাদা দেওয়া সরকারের কর্তব্য, সরকারি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কাম্য নয়। কর্মীদের প্রশ্নহীন বিধিপালন দিয়ে সুপ্রশাসন পাওয়া কঠিন। প্রশাসনিক ব্যবস্থার সকল স্তরে নিযুক্ত কর্মীদের নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশের যথেষ্ট পরিসর রাখা দরকার। কিন্তু এ-ও কি সত্য নয় যে, সামাজিক ন্যায় বিঘ্নিত হলে, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হলে, ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর শর্ত আরোপ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে? পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকসমাজ যদি ছাত্রদের প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল হতেন, দরিদ্র ও প্রান্তিক এলাকার শিশুদের শিক্ষাবঞ্চনা দূর করার প্রতি দায়বদ্ধ হতেন, তা হলে এমন বিধির প্রয়োজন হত না। গ্রামের স্কুলে পড়ানো ‘বাধ্যতামূলক’ ঘোষণা করে শিক্ষামন্ত্রী প্রকারান্তরে শিক্ষকদের ‘অবাধ্যতা’-ই সামনে আনলেন।
এই অভিযোগ ভ্রান্ত নয়। সরকারি শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অসংবেদী মনোভাব বার বার প্রকট হয়েছে। বদলি নিয়ে চলে গেলে গ্রামের স্কুলটি কার্যত অচল হয়ে পড়বে জেনেও বহু শিক্ষক চলে গিয়েছেন শহরে। যখন শহরের স্কুল থেকে বদলির নির্দেশ এসেছে, তখন মামলা করে স্থগিতাদেশ এনেছেন শিক্ষকরা। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে, তবু শিক্ষক সংগঠনগুলিও সদস্যদের এই প্রবণতায় রাশ টানেনি। শিক্ষা দফতরও কি এই অবাধ্যতাকে প্রশ্রয় দেয়নি? ‘উৎসশ্রী’ পোর্টাল যে ভাবে শিক্ষকদের বদলি করেছে, তাতে গ্রামের স্কুল শূন্য করেও শিক্ষকদের অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। শিশুদের শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত হল কি না, তা দেখা হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্নটিও তুলতে হয়। শিক্ষা দফতরের হাতেই ক্ষমতা রয়েছে শিক্ষককে স্কুলের প্রয়োজন অনুসারে গ্রামে বা শহরে নিয়োগ/বদলি করার। তা সত্ত্বেও নতুন করে গ্রামের স্কুলে কাজ করাকে ‘বাধ্যতামূলক’ বলে ঘোষণা করার অন্যতম কারণ এই যে, দলীয় রাজনীতি শিক্ষক-বদলির একটা ছায়া-ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল। ক্রমে গোটা ব্যবস্থাটাই রাহুর গ্রাসে চলে গিয়েছে।
প্রশাসনিক কর্তারা নিয়ম মানলে বিধি মানার অভ্যাস কর্মীদের মধ্যেও তৈরি হয়। না হলে বিধি তৈরি করেও বাধ্যতা মেলে না। আইনের শক্ত আঁটুনি কী ভাবে ফস্কা গেরোয় পরিণত হয়, রাজ্যবাসী তা হামেশাই দেখছে। অতএব, নতুন বিধিটির ফলে রাজ্য সরকার বদলি-প্রতিরোধের মামলা থেকে পরিত্রাণ পেলেও, গ্রামের স্কুলগুলি শিক্ষকহীনতা থেকে কতখানি মুক্তি পাবে, সে সংশয় রয়েই যায়। থেকে যায় উদ্বেগও— গ্রামের স্কুলে পড়াতে ‘বাধ্য’ শিক্ষক আদৌ কি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হবেন, এবং পড়াবেন? সরকারি চিকিৎসকের গ্রামে যাওয়া বাধ্যতামূলক, তাতে গ্রামীণ চিকিৎসার কতটুকু উন্নতি হয়েছে? কেবল বিধিভঙ্গের ভয় দেখানো যথেষ্ট নয়। গ্রামে পড়াশোনার ও পেশাগত কাজের পরিবেশ তৈরি, পরিকাঠামো ও ডিজিটাল সংযোগের উন্নতি— উন্নয়নের এই প্রাথমিক শর্তগুলি শিক্ষা ও চিকিৎসার উন্নতির শর্তও বটে। জরুরি, শিক্ষকের কাজের নিয়মিত পর্যালোচনা, মূল্যায়নের ব্যবস্থা। পাঠদানের প্রতি তাঁদের আগ্রহ তৈরি হোক। দায়বদ্ধতাই কাম্য, বাধ্যতা নয়।