সন্দেশখালিতে চরম উত্তেজনা। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাকে ‘নৈরাজ্য’ বলা চলে না। কেননা, তাতে শব্দটির ব্যঞ্জনা নষ্ট হয়। এই রাজ্যে যে পরিস্থিতি আপাতত দৃশ্যমান— সন্দেশখালি ভয়ঙ্কর স্পষ্টতায় যা আরও প্রকট করে তুলল— তাতে মোটেই রাজ্যশাসনের অভাবজাত নৈরাজ্য নেই, আছে এক সামূহিক অপরাধ-বিস্ফোরণ, যা বর্তমান শাসকের রাজ্য-শাসনের সচেতন ভাবে বাঞ্ছিত ধরন বলে বুঝে নিলে ভুল হবে না। সন্দেশখালিতে ইডি আধিকারিক ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের উপর যে ভয়ঙ্কর হামলা হল— অত্যন্ত সংগঠিত ও সুষ্ঠু ভাবে পরিকল্পিত সেই আক্রমণ। প্রশ্ন জাগে, বড় নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া ছোট নেতানেত্রীরা এমন পূর্ণ ‘শৃঙ্খলা’সহকারে বিশৃঙ্খলা, যথেচ্ছাচার ও হিংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে পারতেন কি? উপরিস্তরের আশীর্বাণী না থাকলে, রাজধানী থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এমন গণহিংসা কি আদৌ ঘটা সম্ভব ছিল? স্থানীয় বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্য বলে একে ভেবে নিলে হয়তো খানিক নিশ্চিন্ত থাকা যেতে পারত। কিন্তু বাস্তব হল, এই রাজ্যের প্রশাসনের নানা স্তরের স্বেচ্ছাচারিতার অভ্রান্ত স্বাক্ষর আরও এক বার ধরা পড়ল সন্দেশখালির সাম্প্রতিক ঘটনায়।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যে পর্যায়ে পৌঁছলে সামাজিক ও সামূহিক মুষলপর্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, এই রাজ্য আজ সেখানেই পৌঁছেছে। ক্ষমতান্ধ শাসকনেতৃত্ব সমাজের দিকে দিকে এই পরিব্যাপ্ত সঙ্কট হয় দেখতে পাচ্ছেন না, নয় দেখেও কোনও স্বার্থ-অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। সমানেই তাঁরা অন্যায়ের এক সীমারেখা পেরিয়ে আর এক নতুন সীমার দিকে পা বাড়াচ্ছেন। যেন রেশন দুর্নীতি কাণ্ডে অভিযুক্ত মন্ত্রীর কারাবরোধই শাসকবৃত্তের অসম্মান ও অনৈতিকতার যথেষ্ট প্রমাণ নয়, এখন সেই মন্ত্রিবরের ঘনিষ্ঠ সহচর শেখ শাহজাহান এবং তৎপোষিত দুর্বৃত্ত-বৃত্তের হামলা দিয়ে সেই মাত্রা আরও প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা করছেন তাঁরা। তৃণমূল শাসনের শুরু থেকেই শাহজাহান-সাম্রাজ্যের বিপুল বৃদ্ধির কথা বহুজ্ঞাত, নেপথ্য আশীর্বাদে তাঁদের নির্ভয় দুর্নীতিপরায়ণতার কথাও। রাজ্যের গণবণ্টন ব্যবস্থার দুর্নীতির মাত্রা দশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার সংবাদের পরও ইডি ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর দিকে বিরাট আক্রমণাত্মক জনতাকে ধাবিত করার মতো প্রবল সাহস ও স্পর্ধা বুঝিয়ে দিল যে, জাতীয় নির্বাচন নিয়েও শাসকপক্ষের বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা নেই। তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবেন পঞ্চায়েত ভোটে সন্দেশখালির দু’টি ব্লক যত সহজে পকেটে পোরা গিয়েছিল, তেমন ভাবেই আগামী ভোটেও বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র হাতের তেলোয় থাকবে। আসলে, গণতন্ত্রের যন্ত্রটিকে কব্জা করে নিতে পারলে যে দুর্নীতি কিংবা দুর্ব্যবহার সানন্দে রাশহীন রাখা যায়, এ রাজ্যের শাসকরা এখন পদে পদে সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন।
আর এই যদি হয় শাসকের স্পর্ধিত দাপট, বিরোধী বিজেপি রাজনীতি-পদ্ধতিটিও রাজ্যের সুস্থ ভবিষ্যতের পক্ষে অতীব অস্বাস্থ্যকর। এই ঘটনায় কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ, এমনকি রাষ্ট্রপতির শাসনের দাবি উঠিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। এও শোনা গিয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে মদত দেওয়ার অভিলাষেই তৃণমূল নেতৃত্ব সমাজবিরোধী নেতাদের অন্যায় প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। বুঝতে অসুবিধা নেই, বিষয়টিকে কোন দিকে ঘোরানোর চেষ্টা হচ্ছে। এক দিকে লজ্জাভয়হীন লাগামছাড়া দুর্নীতি, অন্য দিকে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির ফাঁদ পশ্চিমবঙ্গে ভয়ঙ্কর বিষময় হয়ে উঠছে। জাতীয় নির্বাচন সমাগত প্রায়, ফলে এই বিষাক্ত আবর্ত ক্রমশ বাড়বে। বাড়বে অভিসন্ধিপ্রসূত অনাচারদুষ্ট রাজনীতির কোপ ও প্রতিকোপ। কেউ যদি এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা ও সুবিচারের আশা করেন, তাঁকে সম্পূর্ণ নিরাশ করতে চলেছে ২০২৪ সালের পশ্চিমবঙ্গ। বছরের প্রথমে সেই ‘সন্দেশ’টিই রাজ্যবাসীর সামনে উপস্থিত
করল সন্দেশখালি।