তিস্তা নদী। — ফাইল চিত্র।
জল শুধু জল শেষ পর্যন্ত চিত্ত বিকল করে দিতে পারে কি না, সে কবির প্রশ্ন। কিন্তু সম্পর্ক যে অচল করে দিতে পারে, তা একের পর এক প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের মধ্যে প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। আপাতত ভারত পশ্চিমে সিন্ধু ও পূর্বে তিস্তাকে নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যে জটিলতায় নিমজ্জিত, কোনও দিকেই তার কোনও সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যায় না। তবে সময়ের দিক দিয়ে তিস্তা-সঙ্কট যতখানি পুরনো, পরিচিত এবং অসমাধানযোগ্য, তাতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এর গুরুত্বের কথা ভেবে দু’পক্ষেরই হতাশার বিস্তর কারণ আছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশের দিক থেকে তিস্তা জলবণ্টন নিয়ে কিছু মন্তব্য বিষয়টিতে নতুন মাত্রা যোগ করল। এবং আর এক বার নতুন ভাবে জলবণ্টনের বিকল্প সম্ভাবনার পথ দেখিয়ে দিল— এ বড় আশার কথা। ইতিমধ্যে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের পক্ষে বছরের শুষ্ক সময়ে তিস্তার অতিরিক্ত জল পাওয়া দুরূহ বোঝাই যাচ্ছে, কেননা এখন তিস্তার প্রায় সবটুকু জল গ্রীষ্মকালে গজলডোবা দিয়ে মহানন্দা লিঙ্ক চ্যানেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কৃষি ও পানীয় জলের প্রয়োজন মাথায় রেখে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস যে-হেতু উত্তরবঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে কিছুটা দুর্বল, এই বন্দোবস্ত থেকে সরে আসার সম্ভাবনা শূন্য বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত, আর অনির্দিষ্ট ভাবে অপেক্ষা না করে ভারতের আর্থিক সহায়তায় বর্ষায় জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে বাংলাদেশের অপরিসীম উপকার সম্ভব হবে— এই তাঁর মন্তব্য।
যদিও এই বক্তব্য একেবারেই ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, এবং মনজুর আহমেদ চৌধুরী জানিয়েছেন যে, এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর তেমন কোনও আলাপ-আলোচনা হয়নি— তা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে, এই প্রথম এ বিষয়ে এক স্পষ্ট এবং সম্ভাব্য বিকল্প পথের প্রস্তাব মিলল। উল্লেখ্য, আগামী সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত ভারত সফর প্রসঙ্গে সে দেশের বিদেশসচিব এই ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছেন, তিস্তা-সহ অন্যান্য নদীর জলবণ্টনের বিষয়ে ভারতের ‘নিবিড় সহযোগিতা’র আশা করছে ঢাকা। জনাব চৌধুরীর সাম্প্রতিক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, এমন আশাও এর সঙ্গে হয়তো রাখা যেতে পারে যে, ‘সহযোগিতা’র ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিকল্পও আলোচিত হবে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের দিক দিয়ে বিতর্কে এই ঘটনা এক নতুন মাত্রা সংযোজন। কয়েক দশক ধরে তিস্তার জল বিষয়ক আলোচনা বর্তমান গঙ্গা চুক্তির ধারাটি ধরেই হয়ে আসছিল, যেখানে গ্রীষ্মের শুষ্ক মরসুমে নদীখাতে বাংলাদেশে বেশি জল সরবরাহ করার কথা। প্রসঙ্গত, গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৬ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রিদ্বয় দেব গৌড়া এবং শেখ হাসিনার মধ্যে।
নদীজল দুই দেশের সমাজ ও অর্থনীতির পক্ষেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ, এবং সেই জলের ভাগবাঁটোয়ারাকেও গুরুত্ব দিয়ে মীমাংসার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক, এটাই কাম্য। এ দিকে ভারতে বিষয়টি কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে আলোচনাসাপেক্ষ, এবং রাজ্যের বিবিধ বাধ্যবাধকতা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক বারই তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ভারতের মতো বৃহৎ দেশে আঞ্চলিক স্বার্থের বিষয়টি কূটনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সেটাও নিশ্চয় বাংলাদেশের কাছে স্পষ্ট। বাংলাদেশেও যেমন তিস্তা চুক্তি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতেও তা-ই। এই পরিস্থিতিতে নতুন কোনও সমাধান খোঁজাই একমাত্র বাস্তবসম্মত। যত তাড়াতাড়ি তার হদিস মেলে, দুই দেশের জনসমাজ এবং দুই দেশের সম্পর্কের পক্ষে মঙ্গল।