প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
সাত বছর আগে, ২০১৭ সালে তৎকালীন নরেন্দ্র মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তাঁর বাজেট ভাষণে নির্বাচনী বন্ড প্রবর্তনের প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বাজেট পেশ করার চার দিন আগে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক এই বিষয়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মতামত জানতে চাইলে তারা অবশ্য পত্রপাঠ তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, এই বন্ড কাজে লাগিয়ে অস্বচ্ছ এবং অনৈতিক আর্থিক লেনদেন চলার প্রবল আশঙ্কা আছে। কিন্তু সেই আপত্তি হেলায় উড়িয়ে দিয়ে পরাক্রমী সরকার লোকসভায় অর্থ বিল পাশ করায় এবং ২০১৮ সালের সূচনায় বন্ড চালু করার সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। তবে কিনা, সংসদই গণতন্ত্রের একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়; সেই প্রথম পর্বেই নির্বাচনী বন্ডের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে জনস্বার্থ মামলা রুজু হয়েছিল। অবশেষে, ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিয়েছে যে, এই নির্বাচনী তমসুক ‘অসাংবিধানিক’। প্রসঙ্গত, প্রায় ছ’বছরে এই বন্ড মারফত আনুমানিক অন্তত দশ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি লোকসভা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং মোদীর দল জয়ী হয়ে গদিতে ফিরেছে। আরও একটি নির্বাচন সমাসন্ন। কেউ ভাবতে পারেন, এমন একটি রায় আরও আগে ঘোষিত হলে সংবিধানের শাসন হয়তো আরও জোরদার বলে মনে করা যেত। কিন্তু ন্যায়বিচার কখনও না হওয়ার থেকে দেরিতে হওয়া ভাল।
সুচেতন নাগরিক নির্দ্বিধায় বলবেন যে, সুপ্রিম কোর্ট— আরও এক বার— ভারতীয় গণতন্ত্রের ‘পরম ভরসা’ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রধান বিচারপতি-সহ পাঁচ বিচারকের সিদ্ধান্ত দ্বিধাহীন এবং কঠোর। নির্বাচনী বন্ডের প্রকল্পটি নির্বাচনকে কালো টাকা এবং অন্যায় চাপসৃষ্টি বা প্রলোভনের প্রকোপ থেকে রক্ষা করার কাজে সহায়ক হবে— মোদী সরকারের এই ‘যুক্তি’ নস্যাৎ করে দিয়ে আদালত জানিয়েছে, সংবিধানে সমস্ত নাগরিকের তথ্য জানার যে মৌলিক অধিকার স্বীকৃত, নির্বাচনী বন্ড তাকেই লঙ্ঘন করে। কে এই বন্ড মারফত কোন রাজনৈতিক দলকে টাকা দিচ্ছে, তা জানার পূর্ণ অধিকার নাগরিকদের আছে। এই যুক্তি মেনেই আদালত নির্দেশ দিয়েছে, নির্বাচনী বন্ডের কেনাবেচা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য— এই বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত আর্থিক সংস্থা হিসাবে— স্টেট ব্যাঙ্ক নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে এবং কমিশনকে সেই তথ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জনপরিসরে প্রকাশ করতে হবে। এই নির্দেশ কার্যকর করার পথ মসৃণ না-ও হতে পারে, রকমারি প্রতিবন্ধক সৃষ্ট হতে পারে। তার পরিণাম ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু আপাতত আদালতের রায়টি গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসাবে নতুন আশা জাগিয়েছে, সে-কথা অনস্বীকার্য।
এই রায় থেকে, এবং নির্বাচনী বন্ডের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে, একটি সত্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। শাসকরা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চান, তাঁদের হাতে ছল বল এবং কৌশল সবই থরে থরে মজুত থাকে। গত এক দশকে বর্তমান শাসকদের আচরণ জানিয়ে দেয়, সেই প্রকরণগুলি কব্জি ডুবিয়ে ব্যবহার করতে তাঁরা সতত তৎপর। নির্বাচনী বন্ড তাদেরই অন্যতম। এই বন্ড মারফত সব থেকে বেশি টাকা বিজেপির তহবিলে গিয়েছে— এই পরিসংখ্যান অপ্রত্যাশিত বা বিস্ময়কর নয়। শিল্পবাণিজ্যের চালকরা সব আমলেই শাসক দলের তহবিলে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি টাকা দিতে আগ্রহী থাকেন। কিন্তু এক দিকে নির্বাচনী ব্যয়বাহুল্য এবং অন্য দিকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাষ্ট্রচালকদের ‘সম্পর্ক’— দু’টি ব্যাপারেই মোদী জমানার অভিজ্ঞতা আক্ষরিক অর্থে অভূতপূর্ব। নির্বাচনী বন্ডের পথ বন্ধ হলেই সেখানে মৌলিক কোনও পরিবর্তন ঘটবে, সেই আশা দুরাশা। আবার নির্বাচন এত কাছে এসে যাওয়ার পর এই রায়ে শাসক না বিরোধী কার অসুবিধা বেশি, তাও বিতর্কসাপেক্ষ। তবে সেই সব বিতর্ক আদালতের দায়িত্বপরিধির বাইরে।