ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। ছবি: পিটিআই।
মুখবন্ধ খামে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য আদালতের কাছে পেশ করা স্বচ্ছতার পরিপন্থী, জানিয়ে দিলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। ‘এক পদ এক পেনশন’ মামলায় বকেয়া পেনশন প্রদান বিষয়ে মুখবন্ধ খাম প্রত্যাখ্যান করে তাঁর বেঞ্চ জানায়, এই অভ্যাস ন্যায় বিচারের বিপরীতে যায়, তাই এর প্রচলন এ বার বন্ধ করা দরকার। সুপ্রিম কোর্টের এই অবস্থান যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, গণতন্ত্রকামী মানুষ সমর্থন করবেন, তাতে সন্দেহ নেই। মুখবন্ধ খামে কোনও পক্ষ বক্তব্য পেশ করলে বিরোধী পক্ষ তা দেখতে পায় না, কেবলমাত্র বিচারপতি বা বিচারকরাই তা দেখতে পান। এর ফলে ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়া দু’পক্ষে সমান হয় না— যে পক্ষের কাছে তথ্য প্রকাশ করা হয় না, তার স্বপক্ষ সমর্থন দুর্বল হতে বাধ্য। ইতিপূর্বে একাধিক মামলায় দেখা গিয়েছে, নিম্নতর আদালত মুখবন্ধ খামে যে বক্তব্য গ্রহণ করেছে, শীর্ষ আদালত তা খারিজ করে, সে সব তথ্য প্রকাশ্যে পেশ করতে নির্দেশ দিয়েছে। গত অক্টোবরে অপর একটি মামলায় বিচারপতি চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি হিমা কোহলির বেঞ্চ মুখবন্ধ খামে বক্তব্য পেশ করাকে একটি ‘বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত’ (ডেঞ্জারাস প্রিসিডেন্ট) বলে মন্তব্য করেছিল। দুই বিচারপতি নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, কোন তথ্যের ভিত্তিতে বিচার হয়েছে, তা জানা থাকে না বলে একটি পক্ষ নিম্ন আদালত প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। মুখবন্ধ খামে বক্তব্য পেশ করায় অস্বচ্ছতা ও গোপনীয়তার সংস্কৃতি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মামলায় ক্ষমতার ভারসাম্য ঝুঁকে যাচ্ছে প্রবলতর পক্ষের দিকে, সাধারণত যা হল রাষ্ট্র।
মুখবন্ধ খামে পেশ করা তথ্য গ্রহণ করা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। এর সপক্ষে যুক্তি: যেমন তথ্য প্রকাশিত হলে কোনও চলমান তদন্তের ক্ষতি হতে পারে, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, কোনও ব্যক্তির গোপনীয়তা ভঙ্গ হতে পারে, অথবা যৌন নির্যাতনের মামলায় কোনও নাবালক জড়িত থাকলে তার অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে, তেমন তথ্য সর্বসমক্ষে প্রকাশ না করাই উচিত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও নানা মামলায় মুখবন্ধ খামে তথ্য চেয়েছেন, বা গ্রহণ করেছেন। যেমন, রাফাল যুদ্ধবিমান মামলায় সরকারি গোপনীয়তা আইন রক্ষার স্বার্থে মুখবন্ধ খামে তথ্য চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। ২জি এবং কয়লা কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও মুখবন্ধ খামের তথ্য গৃহীত হয়েছিল।
ইদানীং এই প্রথার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট বার বার অবস্থান করেছে। সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত আদানি শিল্পগোষ্ঠীর দুর্নীতির বিষয়ে হিন্ডেনবার্গ সংস্থার রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে মুখবন্ধ খাম গ্রহণে সুপ্রিম কোর্টের আপত্তি প্রকাশ। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষার্থে যে কমিটি তৈরির প্রস্তাব ওঠে, সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা মুখবন্ধ খামে সেই কমিটির সদস্যরূপে কেন্দ্রের সুপারিশ করা ব্যক্তিদের তালিকা দিতে চান। আদালত তা গ্রহণ করতে রাজি হয়নি ‘পূর্ণ স্বচ্ছতা’ রাখার স্বার্থে। যে তথ্য সর্বসমক্ষে প্রকাশ্য নয়, কেবলমাত্র বিপক্ষের কাছে তা প্রকাশ করার পন্থাও নিয়েছেন কোনও কোনও বিচারপতি। তথ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের শক্তির অন্যতম উৎস। সরকারি তথ্য আদালতে প্রকাশের দায় থেকে রাষ্ট্র সহজে ছাড়া পেলে গণতন্ত্রই দুর্বল হবে। তথ্য না থাকলে কিসের ভিত্তিতে আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াটি চলবে?