সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
এত দিন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ডাকনামে ইডি-র রকম দেখে মনে হচ্ছিল, আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে প্রমাণ ব্যতিরেকেও যে কোনও নাগরিককে গ্রেফতারের পূর্ণ অধিকারে তারা বলীয়ান। দেশের সর্বোচ্চ আদালত গত সপ্তাহে মনে করিয়ে দিল— না, সেই ‘বল’ ইডি-র নেই। ‘পঙ্কজ বনশল বনাম ভারতীয় ইউনিয়ন’ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছে ‘প্রিভেনশন অব মানি-লন্ডারিং অ্যাক্ট’-এ এমন কোনও শর্ত নেই যে কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উত্থাপিত হলেই তাকে সোজাসুজি গ্রেফতার করা যাবে। সাধারণ ভাবে তদন্তে অসহযোগের যুক্তি তুলে ইডি নিজের কার্যধারাকে সঙ্গত বলে দাবি করে। কিন্তু শীর্ষ আদালতের বক্তব্য— অপরাধ অস্বীকার করাকে অসহযোগ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং এই আইনে যে কথা স্পষ্ট ভাবে বলা আছে— সেই দিকটিতে জোর দিতে বলেছেন মহামান্য আদালত: গ্রেফতারকারী অফিসার কেন গ্রেফতার করছেন তা সোজাসুজি লিখিত ভাবে নথিভুক্ত হতে হবে, সেই নথি ঠিক ভাবে স্বাক্ষরিত হতে হবে, এবং নথির প্রতিলিপি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আগেই হাতে দিতে হবে। এই বিধির কোনও ব্যতিক্রম চলবে না। অভিযুক্ত মানেই অপরাধী নন, এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের চেষ্টা করা মানেই অভিযোগ প্রমাণিত নয়। সুতরাং— প্রতিহিংসা নয়— নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার মেনে কোন বিশেষ প্রমাণযোগ্য অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, সেটা নথিবদ্ধ রাখা গণতান্ত্রিক শাসনবিভাগের আবশ্যিক দায়িত্ব।
বর্তমান ভারতে সুপ্রিম কোর্টের এই বক্তব্যের গুরুত্ব কেবল বিরাট নয়, অপরিসীম। নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের এবং তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও অন্যান্য নাগরিকদের যে ভাবে ইডি-র লক্ষ্য ‘বানিয়ে’ তোলা হয়েছে, তা এখন আর কোনও নতুন বা গোপন কথা নয়। এই মুহূর্তে যে সব রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইডি সক্রিয়, তাঁদের ৯৫ শতাংশই বিরোধী নেতা। মার্চ মাসেই চোদ্দোটি বিরোধী দল এই অভিযোগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হয়েছিল যে রাজনৈতিক স্বার্থে ইডি তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাতেও দেখা গিয়েছে, সরকারের তরফে সলিসিটর জেনারেল ‘অসহযোগ’-এর কারণ দর্শিয়ে গ্রেফতারের যুক্তি পেশ করেছেন। এর আগে গত বছর জুলাই মাসে বিচারপতি খানউইলকরের বেঞ্চ থেকে কেন্দ্রকে স্বস্তি দিয়ে বলা হয়েছিল, ইডি-কে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা সংবিধানবিরুদ্ধ নয়। এ বারের রায়টি এই প্রসঙ্গেই বিশেষ জরুরি। বুঝতে অসুবিধা নেই, বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে এই মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি এ এস বোপান্না এবং পি ভি সঞ্জয় কুমারকে নিয়ে গঠিত শীর্ষ বেঞ্চের বক্তব্যটির গুরুত্ব কেন এত সুদূরপ্রসারী। প্রসঙ্গত, রায়টি এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই রিভিউ পিটিশন নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছে সরকার।
স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বারংবার যেমন ঘটেছে— কোনও বিশেষ মামলার রায়ের সূত্রে সর্বোচ্চ আদালত কোনও প্রচলিত আইনের এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে, যাকে অমান্য করে শাসনবিভাগের পক্ষে চলা অন্যায় এবং অনুচিত। বাস্তবিক, গণতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এই পারস্পরিক আস্থার গুরুত্ব একেবারে মৌলিক। যে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাবে সুপ্রিম কোর্টের এই ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ধ্বনিত হল, তা দেশের বিরোধী দলগুলির পক্ষে তো বটেই— সাধারণ নাগরিকের কাছেও অত্যন্ত আশাপ্রদ। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা যে কোনও গণতন্ত্রের মূল কথা। অথচ ইডি এবং সিবিআই-এর অত্যুৎসাহী ব্যবহার ক্রমাগতই গণতান্ত্রিক সমাজকে ধ্বস্ত করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে, কেবল সরকারের নিজের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে চালানো যাবে না— এই সীমারেখাটিই আবার পরিষ্কার করে দিল সুপ্রিম কোর্টের রায়।