সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
কোনও ব্যক্তি অপরাধ ঘটাতে চলেছেন, এই আশঙ্কায় তাঁকে আগাম গ্রেফতার (প্রিভেনটিভ অ্যারেস্ট) করার শর্তগুলি বেঁধে দিল সুপ্রিম কোর্ট। যথেষ্ট কারণ ছাড়া এক ব্যক্তিকে বারো মাস নিবর্তনমূলক আটক করার জন্য তেলঙ্গানা পুলিশকে কঠোর তিরস্কারও করল দুই বিচারপতির বেঞ্চ। দেশ যখন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছে, তখন তেলঙ্গানার কিছু পুলিশ আধিকারিক নাগরিকের মৌলিক অধিকার অগ্রাহ্য করে তাদের স্বাধীনতা খর্ব করছে, আক্ষেপ করেছেন এক বিচারপতি। জাতীয় সুরক্ষা আইন (১৯৮০), বা বিদেশি মুদ্রা পাচার বিরোধী আইনে (১৯৭৪) অপরাধ নিরোধের জন্য সন্দেহভাজনকে আগাম গ্রেফতার করে বারো মাস পর্যন্ত আটক করা যায় অভিযুক্তকে। সেই ক্ষমতা ব্যতিক্রমী বলেই তার প্রয়োগে অতিরিক্ত সাবধান হওয়ার কথা পুলিশের। সন্দেহভাজন ব্যক্তির অতীত অপরাধের নজির রয়েছে, এটা আটক করার জন্য যথেষ্ট কারণ নয়, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছে আদালত। এই সতর্কবার্তা এল এমন সময়ে, যখন বিরোধী, সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের উপর নানা ধারা আরোপ করে গ্রেফতারের প্রবণতা মাত্রা ছাড়াচ্ছে, এবং অভিযোগ আরোপের সঙ্গে অভিযোগ প্রমাণের সংযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অশান্তি ওস্কানোর চেষ্টা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ক) ধারায় গ্রেফতার ব্যক্তিদের মাত্র কুড়ি শতাংশের অপরাধ প্রমাণ করা গিয়েছে আদালতে (২০২০)। ইউএপিএ-র অধীনে তিন বছরে (২০১৮-২০২০) গ্রেফতার হয়েছিলেন ৪৬৯০ ব্যক্তি, দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন কেবল তিন শতাংশ। কিন্তু আইনের ধারা এমনই কঠোর যে, অবশিষ্টরা কেউই জামিন পাননি।
ফলে আশঙ্কা গাঢ় হচ্ছে যে, পুলিশ-প্রশাসন যার উপরে বিরূপ, তাকে বিচারাধীন বন্দি করে জেলে ভরে ‘শিক্ষা দেওয়া’ ক্রমে প্রচলিত রীতি হয়ে উঠছে। আইনের যা প্রকৃত উদ্দেশ্য, অপরাধের প্রতিরোধ এবং প্রতিকার, তা বহু ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা রুখতে শীর্ষ আদালত নিবর্তনমূলক গ্রেফতারের কিছু শর্তাবলি (গাইডলাইন) দিয়েছে। যেমন, ঘটনার প্রাসঙ্গিক সব ক’টি দিকের প্রতি আটককারী কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ মনোযোগ প্রয়োগ করেছে, এবং আইনে উল্লিখিত পরিধির মধ্যেই যে ক্ষমতার প্রয়োগ হয়েছে, এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে আইনি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আটককারী কর্তৃপক্ষের হাতে, সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই সেই ক্ষমতার প্রয়োগ হচ্ছে, অপর কোনও উদ্দেশ্যে হচ্ছে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। তেমনই, আটককারী কর্তৃপক্ষ যে অপর কারও নির্দেশে কাজ না করে স্বাধীন ভাবে কাজ করছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। আটকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে ভিত্তিতে তা অস্পষ্ট হলে চলবে না, তা যথেষ্ট নির্দিষ্ট এবং প্রাসঙ্গিক হতে হবে। আটক করার পরবর্তী কালে পালনীয় আইনি বিধিগুলি মানতে হবে পুলিশকে।
যে কোনও গ্রেফতারের ক্ষেত্রেই এই শর্তগুলি প্রণিধানযোগ্য। প্রশ্ন উঠবে, আইন প্রয়োগের এই মৌলিক শর্তগুলি না জেনেই কি পুলিশ-প্রশাসন কাজ করছিল এত দিন? নিশ্চয়ই তা নয়, আইন ও বিধির মধ্যেই সংযত প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। তবে নাগরিকের কাছে পুলিশের দায়বদ্ধতার বোধটি আবছা হয়ে আসছে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নাগরিক এবং পুলিশ, উভয়ের কাছেই সমান জরুরি। গত বছর জুলাইয়ে ভারতে বিচারাধীন বন্দিদের সংখ্যার আধিক্যের দিকে নির্দেশ করে শীর্ষ আদালত বলেছিল, গণতন্ত্র কখনও পুলিশ রাষ্ট্র হতে পারে না। জামিন না দিয়ে দীর্ঘ দিন বন্দি করে রাখা নাগরিকের স্বাধীনতার পরিপন্থী, তাই নিতান্ত প্রয়োজন না হলে গ্রেফতারের ক্ষমতার প্রয়োগ করা যাবে না। সেই কথাটি নতুন করে মনে করাল শীর্ষ আদালত। এ কেবল বিধিপালনের নির্দেশ নয়, গণতান্ত্রিক ভারতের ধারণার প্রতি শ্রদ্ধার আহ্বান পুলিশ ও প্রশাসনকে।