—প্রতীকী চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচন এক ধরনের যুদ্ধ, যাতে স্কুলের চেয়ার টেবিল থেকে জানলা দরজা অবধি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়— পশ্চিমবঙ্গের কোনও শিশু অতঃপর তার খাতায় এমন বাক্য লিখতেই পারে। রাজনৈতিক হিংসার উপদ্রবে এই রাজ্য অনেক দিনই কার্যত ভারতসেরা। ভোট এলে, বিশেষত রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত পঞ্চায়েত ভোট সমাগত হলে সেই উপদ্রব এক উৎকট আকার ধারণ করে, এই অভিজ্ঞতাও নতুন নয়। কিন্তু এ-বারের অশান্তিপর্বে বাড়তি মাত্রা সংযোজন করেছে ভোটকেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত বিভিন্ন স্কুলে নির্বাচনের বিধ্বংসী অভিঘাত। বহু স্কুলে ভোটের দিন ভাঙচুর হয়েছে অথবা অন্য ভাবে স্কুলবাড়ি ও তার আসবাবপত্র এবং সাজসরঞ্জামের ক্ষতি হয়েছে। তার পিছনে ছিল এক দিকে ‘রাজনৈতিক কর্মীদের ক্ষোভ’, অন্য দিকে কিছু কিছু ভোটকর্মী এবং অন্যদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ। আশার কথা, এই রাজ্যের পরিচিত সামাজিক ঔদাসীন্যের ধারায় অন্তত আংশিক ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এই ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কিছু প্রতিবাদী উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একাংশ আগেই সরব হয়েছিলেন, অতঃপর এই প্রশ্নে কলকাতা হাই কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের হয়। উচ্চ আদালত নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারকে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপ্তি ও মাত্রা যাচাই করে সরকারি খরচে তার পূরণের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে। এবং বিচারপতিরা জানিয়েছেন, এই ভাঙচুরের জন্য যারা দায়ী, সরকার তাদের চিহ্নিত করে ক্ষতিপূরণের টাকা তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারবে।
এই নির্দেশ কেবল অভিবাদন দাবি করে না, এতদ্দ্বারা একটি বড় রকমের সংস্কারের সম্ভাবনাও তৈরি হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে যথেচ্ছাচারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় লাগাম পরানোর সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কাজে পরিণত করা অত্যন্ত কঠিন। প্রতিবাদের নামে সরকারি বা জনপরিসরের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের পরম্পরা বহু দিনের। বিভিন্ন উপলক্ষে আদালত অনেক বার অপরাধীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে, কাজের কাজ বিশেষ হয়নি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলগুলির ক্ষেত্রে যদি অন্তত কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীদের চিহ্নিত করে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়, বড় কাজ হবে। তবে কিনা, রাজধর্ম পালনে রাজ্য সরকার তথা তার চালক রাজনীতিকদের উৎসাহ বা নিষ্ঠার যে নমুনা দেখা গিয়েছে, তাতে এ বিষয়ে ভরসা রাখা সহজ নয়। বরং আশঙ্কা হয়, ভাঙচুরের জন্য কোথায় কারা দায়ী, তার অনুসন্ধান নিজের লোকদের বাঁচানো এবং বিরোধী দল বা মতের অনুসারীদের উপর আর এক দফা অত্যাচারের কৌশল হয়ে দাঁড়াবে না তো? এই আশঙ্কা যাতে সত্য না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্যও আদালতের নজরদারি সম্ভবত অত্যাবশ্যক।
এই সূত্র ধরেই উঠে আসে গভীরতর একটি প্রশ্ন। স্কুলগুলিকে নির্বাচনের আওতার সম্পূর্ণ বাইরে রাখার প্রশ্ন। যে কোনও ভোট এলেই বহু স্কুল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গ্রাসে চলে আসে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ পঠনপাঠনের ক্ষতি হয়, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের ভোটের কাজে নিযুক্ত করা হয়— এই ঐতিহ্য থেকে আজও কেন স্কুলশিক্ষার মুক্তি হল না? নির্বাচনের মতো একটি নিয়মিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে চালানোর জন্য যথাযথ পরিকাঠামো কেন তৈরি করা গেল না? সহজ উত্তর: রাজনীতির নিয়ামকদের কাছে স্কুলের স্বার্থ, শিশু-কিশোরদের শিক্ষাদীক্ষার স্বার্থ নিতান্তই গৌণ, প্রায়শ অকিঞ্চিৎকর। এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদের তুলনা মেলা ভার, তাঁরা শিক্ষা নিয়ে, বিশেষত স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে এক মুহূর্ত সময় ব্যয় করতেও নারাজ, কোভিডের কাল থেকে আজ অবধি তার ধারাবাহিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি বিচারে এই ভয়াবহ উপেক্ষা কিন্তু সমস্ত ভাঙচুরের থেকেও বেশি ক্ষতিকর। কোনও ক্ষতিপূরণের অঙ্কে তার হিসাব মিলবে না।