—প্রতীকী ছবি।
সরকারকে নির্দেশিকা জারি করতে হচ্ছে— রাজ্যের স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের দিয়ে শৌচালয় পরিষ্কার করানো চলবে না— এই মর্মে। আধুনিক ভারতে এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে। এমনটাই ঘটেছে কর্নাটকে। সেখানে অন্তত তিনটি স্কুলে শৌচনালা এবং শৌচালয় পরিষ্কার করার কাজে বিশেষ কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়োগ করা হয়েছিল বলে খবর। অতঃপর কর্নাটকের স্কুলশিক্ষা এবং সাক্ষরতা সংক্রান্ত দফতর থেকে এ-হেন নির্দেশনামা জারি হয়েছে। পর পর দু’টি ঘটনার কথা শোনামাত্র সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষদের সতর্ক করা হয়েছিল। তৎসত্ত্বেও তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছে। এই অ-মান্য শুধুমাত্র সরকারের পক্ষেই অস্বস্তির কারণ নয়, সামাজিক ক্ষেত্রে এবং বিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঘটনাগুলি ভুল বার্তাবাহী।
শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করবে, খেলাধুলা ও নানাবিধ কর্মসূচিতে যোগদান করার সঙ্গে বিদ্যালয় পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাসও রপ্ত করতে পারে। বাস্তবিক, করাই উচিত।। কিন্তু তার বাইরে জোর করে তাদের দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কার করানো এক প্রকার নির্যাতনের শামিল। কোনও কাজই হীন নয়, হেয় নয়, কিন্তু তাই বলে সব কাজ সবাইকে দিয়ে করানো চলে না। যে কোনও প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা উচিত— যে কোনও সভ্য সমাজে এটাই দস্তুর। কর্নাটকে সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত অর্থ প্রদান করা হয় সরকারের তরফ থেকে। বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে সেই প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিমাণটি সন্তোষজনক না হলে বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট কর্মীর অভাব থাকলে সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট বিভাগে সমস্যার কথা তুলে ধরবেন এবং সমাধানের পথটি বার করবেন। শিক্ষার্থীরা এর বিকল্প হতে পারে না। অবশ্য বিষয়টি শুধুমাত্র শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক নয়। কোলার জেলার অনগ্রসরদের আবাসিক বিদ্যালয়ে যে সব শিক্ষার্থীকে শৌচনালা পরিষ্কারের কাজে বাধ্য করা হয়েছিল, তাদের অনেকেই দলিত। সুতরাং, জাতপাতদীর্ণ সমাজ দলিতদের সঙ্গে এই পেশার যে যোগ দেখতে পান, তার সঙ্গে ঘটনাটির যোগসূত্র স্পষ্ট।
প্রসঙ্গত, মনে পড়তে পারে, স্বনির্ভরতার আদর্শবাদে আদ্যন্ত বিশ্বাসী গান্ধীজি একদা সুষ্ঠু নিকাশিব্যবস্থাকে স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পরিচ্ছন্নতা এবং নিকাশিব্যবস্থা বিষয়ে প্রত্যেকে জ্ঞাত হোক। সেই আদর্শ মেনে গান্ধীবাদী আশ্রমে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় চত্বর এবং শৌচাগার পরিষ্কার করতে হত। শৈশব থেকেই পরিচ্ছন্নতার পাঠটির সঙ্গে এক সার্বিক আত্মনির্ভরতার মন্ত্র শেখানো হত। গান্ধীর এই আদর্শ ছিল সমন্বয়ী, তাঁর অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ, যেখানে সমাজের ময়লা সাফ করার দায়িত্বটি শুধু হরিজন সম্প্রদায়ের নয়, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের। কর্নাটকের সাম্প্রতিক ঘটনায় কিন্তু কখনওই সেই উন্নত আদর্শের প্রতিফলন দেখা সম্ভব নয়। এই পদক্ষেপ সেখানে করা হয়েছে— শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে নয়, প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থে। এবং অন্তরে-অন্দরে গান্ধী-আদর্শের বিরুদ্ধস্বর— এক বিভেদকামী মানসিকতাকে খুঁচিয়ে তোলা হয়েছে, যেখানে দলিত ছাত্রদেরও বিরুদ্ধে বিভেদ চলে। শিক্ষাঙ্গনে এই সামাজিক বৈষম্যের চর্চা অত্যন্ত আপত্তিকর।