দশ দিনের জন্য স্কুলপড়ুয়াদের লেখাপড়া মুলতুবি রাখতে দ্বিধা করল না সরকার। ফাইল চিত্র।
সরকারি কর্মসূচি দিয়ে কেমন করে স্কুলশিক্ষাকে বানচাল করা যায়, তা ফের দেখাল রাজ্য সরকার। ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির জন্য তুলে নেওয়া হয়েছে স্কুলশিক্ষকদের, দখল করা হয়েছে সরকারি স্কুল, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রথম সামগ্রিক মূল্যায়নের সময়সূচি পিছিয়ে গিয়েছে সারা রাজ্যে। এক কথায়, দশ দিনের জন্য স্কুলপড়ুয়াদের লেখাপড়া মুলতুবি রাখতে দ্বিধা করল না সরকার। কলকাতা পুরসভার একটি স্কুলে গিয়ে সাংবাদিকরা যে ছবি দেখেছেন, তা যেমন লজ্জাজনক, তেমনই উদ্বেগের। চার জন শিক্ষকের তিন জনকেই পাঠানো হয়েছে ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরের কাজে, এক জন শিক্ষক চারটি শ্রেণির শিশুদের সামলাচ্ছেন, সহায়তা করছেন এক মিড-ডে মিল কর্মী। বর্ধমানের পানাগড় রেলওয়ে কলোনির একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলি শিবিরের জন্য দখল করে নেওয়ায় পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে স্কুল। সারা রাজ্যেই এই চিত্র— স্কুলের দরজা খোলা থাকলেও লেখাপড়া কার্যত স্থগিত। রাজ্যের কয়েক লক্ষ শিশুকে দশ দিনের পঠনপাঠন থেকে বঞ্চনার দায় গ্রহণ করবে কে? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সে প্রশ্নের উত্তর দেবেন, এমন আশা কম। অথচ, প্রশ্নগুলির ওজন কম নয়। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ বহু আগেই পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করে দেওয়া সত্ত্বেও কেন ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির জন্য পরীক্ষা পিছোতে হল? শনি-রবিবার স্কুলগুলিতে শিবির হোক, শিক্ষকদের এমন প্রস্তাব মানতে রাজি হল না কেন রাজ্য সরকার? কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা করেছিলেন, পুরসভার স্কুলে শিবির হবে না। সে নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে কেন পুরসভার স্কুলগুলিতে শিবির করা হল?
কোনও যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যার অভাবে যে মতটি প্রাধান্য পাচ্ছে তা হল, সামনে পঞ্চায়েত ভোট বলে সরকার বিবিধ প্রকল্পের প্রতি নাগরিককে আকর্ষণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে সরকারি রীতিনীতির সীমা লঙ্ঘন করতে রাজ্য সরকার দ্বিধা করছে না। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতির প্রকাশিত কর্মসূচি, বা পুরসভার মেয়রের ঘোষিত আশ্বাস সরকারই উড়িয়ে দিচ্ছে। ‘দুয়ারে সরকার’ এই প্রথম হচ্ছে, এমন নয়। এর আগেও স্কুলগুলি দখল করে নানা ধরনের সরকারি শিবির বসিয়েছে সরকার। নির্বাচন থেকে সেনা শিবির, সব ধরনের কাজের জন্য সরকারি স্কুলের ভবনগুলিকে ব্যবহার করা হয়েছে। তার ফলে স্কুলশিক্ষা যে বিপর্যস্ত হয়েছে, পড়াশোনার মান নেমেছে, ছেদ পড়েছে নিয়মিত কার্যসূচিতে, তা নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজ, দু’তরফ থেকেই সমালোচিত হয়েছে রাজ্য সরকার।
আপত্তির প্রধান কারণটি অসুবিধা নয়, অনৈতিকতা। সরকার-পোষিত হলেও স্কুল হল স্বাধীন, স্বতন্ত্র এক প্রতিষ্ঠান। সরকারি স্কুলভবনকে রাজ্য সরকার কখনওই সরকারি দফতরের মতো ব্যবহার করতে পারে না, সরকারি শিক্ষকদেরও সরকারি কর্মীদের মতো যে কোনও কাজে লাগাতে পারে না। সরকার স্কুলব্যবস্থার কাছে দায়বদ্ধ। অপর দিকে, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ও কল্যাণ ছাড়া অপর কোনও দায়বদ্ধতা নেই স্কুলের। তার উপর অন্য কাজের চাপ তৈরি নীতিবিরুদ্ধ এবং ক্ষতিকর। তবু স্কুল দখলের পথ থেকে সরে আসতে নারাজ রাজ্য সরকার। শ্রেণিকক্ষ দিতে আপত্তি করলে স্কুলের মাঠে শিবির করা হচ্ছে। অথচ, ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি ঘিরে সুপরিকল্পিত ভাবে একটা উৎসবের মেজাজ তৈরি করা হয়। ঢাকি, লোকসঙ্গীত শিল্পী, মাইকের ঘোষণা, ভিড়ের চাপ— এগুলিই হয়ে উঠেছে এই কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য। এই কি লেখাপড়ার পরিবেশ? করোনা অতিমারিতে দীর্ঘ ছুটির জন্য স্কুলশিক্ষার ক্ষতির বহর অজানা নয়। এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার কথা স্কুলগুলির। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের স্কুল খুলে রাখতে বলে স্কুল ভবনে ‘দুয়ারে সরকার’ শিবির চালানো ভণ্ডামির নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়।