Economy

অন্যের দায়

২০১৪ সালের মে মাস থেকে পরিসংখ্যান বিচার করলে ভারতীয় টাকার দামের পতনের প্রবণতাটি স্পষ্ট দেখা যাবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২২ ০৬:৪২
Share:

টাকার শক্তিক্ষয়।

বহু কাল আগে, কোনও এক ছবিতে একটি আদালত-দৃশ্য ছিল, যেখানে উকিল-বেশী নায়ক একটি কালজয়ী সওয়াল করেছিলেন— হুজুর, এ কথা সত্যি যে সিঁড়িটি নীচ থেকে উপরে যায়, কিন্তু এর প্রমাণ কোথায় যে এই সিঁড়িটিই উপর থেকে নীচে নামে? এত দিন অবধি এই যুক্তিটি আক্ষরিক অর্থেই অ-দ্বিতীয় ছিল। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তার সেই গৌরব কেড়ে নিলেন। ডলারের সাপেক্ষে টাকার নিম্নগামী দর বিষয়ে নির্মলা যে যুক্তিটি পেশ করলেন, তা নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি চলছে। কথাটি অবশ্য হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ডলারের সাপেক্ষে টাকার এক্সচেঞ্জ রেট বা বিনিময় মূল্য একটি অনুপাত, যার এক দিকে টাকা, অন্য দিকে ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যদি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তা হলে তার তুলনায় টাকার দাম কমাই স্বাভাবিক। টাকার নিজস্ব শক্তি যদি অপরিবর্তিত থাকে, এমনকি, টাকা যদি শক্তিশালীও হয়, কিন্তু ডলারের গুরুত্ব আরও বাড়ে, তা হলেও ডলারের সাপেক্ষে টাকার বিনিময় মূল্য কমবে। অর্থমন্ত্রী তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে এই কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু, তাঁর জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতে সেই যুক্তিতে একটি মস্ত ফাঁক থেকে গিয়েছে— টাকা ছাড়াও দুনিয়ায় আরও মুদ্রা রয়েছে, এবং ডলারের সাপেক্ষে সবেরই বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয়। যদি কেবল ডলারের শক্তিবৃদ্ধির কারণেই টাকার দাম নিম্নগামী হত, তা হলে সেই পতনের হার বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রার পতনের হারের সঙ্গে তুলনীয় হত। অর্থমন্ত্রী এই অঙ্কটি সম্ভবত কষে দেখেননি। কষলে তিনি জানতেন, চির-বিপর্যস্ত পাকিস্তান, অথবা অধুনা চরম টালমাটালের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীলঙ্কা বা ইংল্যান্ডের মতো কিছু দেশের মুদ্রার কথা বাদ রাখলে, ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় টাকার পতনের হারটি উদ্বেগজনক রকম বেশি। এই হিসাবটি এক-দু’দিনের নয়। ২০১৪ সালের মে মাস থেকে পরিসংখ্যান বিচার করলে ভারতীয় টাকার দামের পতনের প্রবণতাটি স্পষ্ট দেখা যাবে।

Advertisement

অতএব, অর্থমন্ত্রী যা-ই বোঝান না কেন, টাকার যে শক্তিক্ষয় হচ্ছে, তাতে সংশয় নেই। ঘটনা হল, সেই পতনের জন্য কেউই একক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার বা অর্থমন্ত্রীকে দায়ী করবেন না— টাকার দাম বহুবিধ কারণে কমে, এবং তার সব ক’টি অন্তত প্রত্যক্ষ ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে না। অর্থমন্ত্রী তবুও কুযুক্তি খাড়া করে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন কেন, সেটিই আসল প্রশ্ন। অথবা, সেটি কোনও প্রশ্নই নয়— যে কোনও প্রকারে দায় অস্বীকার করাই এই সরকারের মূলগত ধর্ম। আন্তর্জাতিক সূচকে ভারতের অবনমন ঘটলে নেতারা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দেখতে পান; দেশের মধ্যে থেকে সমালোচনার সুর শোনা গেলেই দেশদ্রোহী হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সুপরামর্শ দিয়ে থাকেন মেজো-সেজো নেতারা। অর্থমন্ত্রী আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পেড়ে বসেছেন— অর্থাৎ, ইন্ডিয়ার অ্যাসোসিয়েশনে টাকা ভারিক্কি ছিল, ওজন ২ মন ৩০ সের, কিন্তু গেঁড়াতলা কংগ্রেস কমিটিতে যাওয়ামাত্র তার ওজন হয়ে গেল মাত্র ৫ ছটাক, ফুঁয়ে উড়ে গেল! একেই কুযুক্তির একমাত্র উদাহরণ ভাবলে ভুল হবে। এই সরকার একেবারে প্রথম দিন থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য সব যুক্তি খাড়া করে। নোট বাতিল তার মোক্ষমতম উদাহরণ। একটি প্রশ্ন অবশ্য থাকে— নেতারা যখন এই কুযুক্তির জাল বিস্তার করেন, তখন কি তাঁদের সংশয় হয় না যে, কেউ তথ্য পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখে তাঁদের কথার সারবত্তা বিচার করতে পারে? না কি, তাঁরা দেশবাসীকে নির্বোধ ভাবতে এমনই অভ্যস্ত হয়েছেন যে, কোনও কথাই আর তাঁদের মুখে আটকায় না? অবশ্য, দেশবাসীরও দোষ আছে— এখনও অবধি যারা ‘অচ্ছে দিন’-এর রূপকথায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস হারায়নি, তাদের বোধবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement