—ফাইল চিত্র।
রামের কাহিনির সঙ্গে লঙ্কার কাহিনি ওতপ্রোত জড়িত, কিন্তু অতি দর্পে লঙ্কার কী হয়েছিল, সে কথা আধুনিক রাম-প্রচারীরা হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন। কিছু দিন ধরেই একটি দর্পিত দাপট দৃশ্যমান, যেখানে দলকে ছাপিয়ে যাচ্ছিলেন ব্যক্তি, ভিত্তিকে ছাপিয়ে যেতে বসেছিল স্তম্ভ— অন্তত তেমনই একটি বার্তা বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী মোদীকে দিতে চাইছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। কিছু দিন ধরেই রাজনীতি-বিশেষজ্ঞরা মনে করছিলেন, আরএসএস-এর দিক থেকে কোনও বার্তা আসতে পারে। সেই প্রতিক্রিয়া শেষ অবধি এল ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের মুখে শোনা গেল কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপির ব্যঙ্গসিক্ত সমালোচনা— প্রকৃত সঙ্ঘ-সেবক যিনি, তিনি নিজের কাজ করেন, কিন্তু নিজের মুখে কদাপি উচ্চারণ করেন না কত কাজ করা হচ্ছে। বক্রোক্তির তিরটি সোজাসুজি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকে, কেননা ভোটপ্রচার চলাকালীন মোদী বারংবার দাবি করেছেন যে তিনি প্রথমত এবং শেষত এক জন ‘সেবক’। মোদী আরএসএস-এর পুরনো কর্মী ছিলেন, এ কথা তিনি বলতেই পারেন। কিন্তু আরএসএস তাঁকে কিছুটা দূরে ঠেলতে চায় কি না, সে প্রশ্ন উঠছিল আগেই, এ বার ভাগবতের মন্তব্য তাকে তীক্ষ্ণমুখ করে দিল। আন্দাজ করা যেতে পারে, সঙ্ঘের প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনের সময়-নির্বাচনের পিছনে বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডার প্ররোচনামূলক সাক্ষাৎকারটিও একটি ভূমিকা পালন করেছে। ভোটের শেষ দফার অব্যবহিত আগে, ৩১ মে, নড্ডার সাক্ষাৎকারে পড়া গিয়েছিল, আরএসএস-কে সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিজেপিকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে চরিত্রায়িত করে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যবধানটি বুঝিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
আরএসএস ও বিজেপির এই পারস্পরিক উষ্ণশীতল সম্পর্কের ধারাপাত কোনও নতুন ঘটনা নয়। গত কয়েক দশকে এত বার তা দেখা গিয়েছে যে অনেক বিশেষজ্ঞ এই দুই প্রতিষ্ঠানের পিংপং-সম আদানপ্রদানকে একটি রাজনৈতিক কল্প-প্রকল্প বলে মনে করেন, মানুষকে ভুল বোঝানোর পরিকল্পনা দেখেন এর মধ্যে। সম্প্রতি আরএসএস নেতা রাম মাধবের মুখেও শোনা গিয়েছে দূরত্ব তৈরির কথা: সঙ্ঘের কাজ জাতিগঠন করা, রাজনীতি করা নয়। কেউ যদি এর মধ্যে ভোটের ভরাডুবির পর হিন্দুত্বপ্রকল্পের পুনরুদ্ধারের প্রয়াস দেখেন, বিজেপির খারাপ ফলাফলের পাশ কাটিয়ে আরএসএস-এর জাতিপ্রকল্পের জয়কে জনমানসে প্রাধান্য দেওয়ার নকশা দেখেন, তাঁর ভাবনাকে ভুল বলা যায় না। তা ছাড়া, আরএসএস-এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটা রাম মাধব প্রমুখ যেমন বলছেন, ততটা সরল-সোজা নয়। গোলওয়ালকরের কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে: যদি মনে করা হয় সঙ্ঘসেবক কেবল রাজনীতি করবেন, তবে তাঁর কাজটা জলের বাইরে মাছকে বেঁচে থাকার চেষ্টার মতো, কিন্তু যদি নিজের কাজের সঙ্গে কাউকে রাজনীতি চালনার মতো কোনও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়, তা হলে তাঁকে সেটা করতেই হয়— অভিনেতাকে যেমন যে কোনও ভূমিকাতে অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, সঙ্ঘও সেবককে কাজ দিলে তা করতে তিনি বাধ্য থাকেন।
ফলে আরএসএস-এর বিজেপি-ভর্ৎসনাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা কেবল মুশকিলের নয়, বিপজ্জনকও। ইতিহাস বলছে, কোনও গভীর অর্থে আরএসএস ও বিজেপির দূরত্ব ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং এ হল দূরত্বের ছলনা, রাজনীতির প্যাঁচ, যার থেকে উভয় পক্ষেরই লাভবান হওয়ার কথা। বিজেপি এখন একাই একশো, এ কথা যখন নড্ডা উচ্চারণ করেন, তার মধ্যেও সেই প্যাঁচেরই ইশারা। আরএসএস-এর সতর্কবার্তা সম্ভবত আজ শোনা যাচ্ছে ভোট-ফলের প্রেক্ষাপটটি কিছুটা হতাশাজনক বলেই। নচেৎ গত কয়েক বছরের মতোই এখনও বিদ্বেষ আর বিরোধের প্রচারের পদতলে ‘সেবা’র কথা সম্ভবত ধুলোতেই মিশে থাকত।