—প্রতীকী ছবি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ যাঁদের, তাঁরা যদি নিজ ভূমিকাটি ক্ষণে ক্ষণেই বিস্মৃত হন, তবে নাগরিক জীবন সুরক্ষিত থাকে না। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যান চলাচলের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই ঘটছে, প্রতিনিয়ত। একের পর এক দুর্ঘটনা, মর্মান্তিক মৃত্যুমিছিলের শেষ দেখা যাচ্ছে না সেখানে। সম্প্রতি যেমন বালি ও বেলুড়ের মাঝে বেপরোয়া লরিতে ধাক্কায় অকালেই মৃত্যু ঘটেছে এক তরুণীর। ওই অঞ্চলে এ-হেন দুর্ঘটনা বিরল ব্যাপার নয়। রাত ন’টার পর কার্যত বেপরোয়া লরি ও ট্রাক চালকের মুক্তাঞ্চল হয়ে ওঠে জায়গাটি। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশকে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। সুতরাং, প্রাণ দিয়ে সেই বিশৃঙ্খলার মূল্য চোকাতে হচ্ছে বার বার।
কলকাতার অবস্থাও একই রকম। কিছু দিন আগেই কৈখালি এলাকায় ডাম্পার এবং স্কুটারের ধাক্কা প্রাণ কেড়েছিল ১২ বছরের এক কিশোরীর। গত কয়েক মাসে কখনও বেপরোয়া লরি, কখন রেষারেষি করতে যাওয়া বাসের ধাক্কায় একের পর এক পথচারীর মৃত্যু অথবা অঙ্গহানির খবর সংবাদে উঠে এসেছে। পথে বেরোলে নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা নেই— এ-হেন পরিস্থিতি কি কোনও সভ্য শহর বা শহরতলির ভবিতব্য হতে পারে? প্রসঙ্গত, খাস মহানগরীতে গণপরিবহণ ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ার মুখে। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সির সংখ্যা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। কিন্তু তাতেও যে দুর্ঘটনা কমছে না, সেটা ভাবার বিষয়। প্রথম কারণ অবশ্যই পুলিশ-প্রশাসনের সার্বিক অপদার্থতা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আইন, শাস্তির ব্যবস্থা— সব থাকা সত্ত্বেও বড় মাপের দুর্ঘটনা ছাড়া পুলিশের শীতঘুম ভাঙে না। দ্বিতীয় কারণ, পুলিশকর্মীদের একাংশের অর্থলিপ্সা। রাত ন’টার পর কলকাতা-সংলগ্ন বিভিন্ন রাস্তায় লরির উপদ্রব অনায়াসে বাড়তে পারে, কারণ লরিচালকরা আইনকে ফাঁকি দেওয়ার উপায়টি নিয়মিত কাঞ্চনমূল্যে কিনে নেন। ফলে, অভিযোগ জানালেও কেন পুলিশ সাড়া দেয় না, কারণটি সহজবোধ্য। বালির সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় লরিচালককে আটক করা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা নিয়মিত আইন ভাঙেন, তাঁদের কত জন উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছেন? গত বছর ডায়মন্ড হারবার রোডে দু’টি বেসরকারি বাসের মধ্যে এক দুর্ঘটনার পর জানা গিয়েছিল একটি বাসের বিরুদ্ধে তিনশোরও অধিক ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গের কেস নথিবদ্ধ। তা সত্ত্বেও তার পথে নামা আটকানো যায়নি। পুলিশের এই ঢিলে দেওয়ার মনোভাবই চালকদের ফের আইন ভাঙতে ইন্ধন জুগিয়েছে।
তবে, নাগরিক দায়ও কিছু কম নেই। ট্র্যাফিক আইন না-মানা, হেলমেটহীন চলাচল, এবং রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ও বাইকের গতির দৌড়— কোনওটির অপরাধ বেপরোয়া বাস-লরির চেয়ে কম নয়। পশ্চিমের দেশগুলিতে ট্র্যাফিকবিধি মানার ক্ষেত্রে যে একনিষ্ঠতা দেখা যায়, এ রাজ্যে তা ভয়ঙ্কর ভাবে অনুপস্থিত। সম্প্রতি এক রাতে দুই পৃথক দুর্ঘটনায় এক স্কুটার এবং এক বাইকচালকের মৃত্যুর কারণও ছিল ট্র্যাফিকবিধি না-মানার এই উদ্ধত প্রবণতা। কলকাতা এবং তার সংলগ্ন অঞ্চল অত্যধিক জনবহুল। এই সমগ্র অঞ্চলে যান চলাচল মসৃণ রাখতে এবং একই সঙ্গে নাগরিক জীবন সুরক্ষিত রাখতে প্রশাসন এবং নাগরিক— উভয় তরফকেই সচেতন এবং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখতে হবে। তার বিন্দুমাত্র যে এখনও পর্যন্ত দৃশ্যমান হচ্ছে না, এটাই দুশ্চিন্তার।