ফাইল চিত্র।
গরিব যাহা সৃষ্টি করে, ধনী তাহা লুণ্ঠন করে— চার বৎসর পূর্বে ইউরোপের খ্যাতনামা ক্লাব পিএসভি আইন্দহোভেনের বিরুদ্ধে ম্যাচে গ্যালারিতে এই পোস্টার সাজাইয়াছিলেন টিউনিসিয়ার এক অনামা ক্লাবের সমর্থকদল। আদিতে শ্রমজীবী মানুষের খেলা ফুটবল এ-কালে যে ভাবে বড় ক্লাব তথা অতিকায় পুঁজির কুক্ষিগত হইয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইতেই এই পোস্টার। সেই ক্রান্তিগর্ভ বাক্যটি সম্প্রতি ইউরোপে ফিরিয়া আসিয়াছে। ব্রিটিশ লেবার পার্টির জেরেমি করবিন-সহ অনেকেই তাহার প্রতিধ্বনি করিতেছেন। উপলক্ষ ইতিমধ্যে সুবিদিত। ইউরোপের সর্বাধিক নামকরা (এবং ধনীতম) বারোটি ক্লাব জোট বাঁধিয়া একটি লিগের পরিকল্পনা করিয়াছিল, যেখানে তাহারা হইবে স্থায়ী সদস্য, অর্থাৎ তাহাদের যোগ্যতা নির্ণয় এবং যাচাইয়ের প্রয়োজন হইবে না, সকল ম্যাচ খেলিবার সুযোগ পাইবে এই ক্লাবগুলি। বিশ্বসেরা হউক বা অর্বাচীন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বা ইপিএল-এর ন্যায় ইউরোপ-সেরা টুর্নামেন্টগুলিতে সকলকেই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হইতে হয়। সেই সুযোগে কখনও ইন্দ্রপতন ঘটিয়া যায়, চমক সৃষ্টি করে কোনও অর্থক্লিষ্ট ক্লাব। আবার, অকস্মাৎ বাদ পড়িতে পারে বৃহৎ ক্লাবগুলি। এই অনিশ্চয়তা ও লোকসানের আশঙ্কাই তাহারা আর মানিতে চাহে না। অর্থের জোরে নিশ্চিত মুনাফার স্বর্গ নির্মাণের কৌশল: স্বতন্ত্র লিগ। বিশ্ব-রাজনীতিতে যে উগ্র দক্ষিণপন্থী স্বর জোরদার হইতেছে, ফুটবলেও তাহার প্রতিফলন।
কিন্তু ক্ষমতাবানদের সাধ মিটে নাই। তাহাদের বাণিজ্যিক কৌশলের কথা প্রচারিত হইবার অল্পকালের মধ্যেই তাহার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ ফাটিয়া পড়িয়াছে। সেই বিদ্রোহে অগ্রণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ওই বারোটি ক্লাবের সমর্থকরাই। আশার কথা, সমাজের সর্বস্তরে— রাষ্ট্রপ্রধান হইতে সামান্য সমর্থক— প্রবল প্রতিবাদের ধ্বনি অতি দ্রুত বিস্ফোরণের আকার ধারণ করিয়াছে এবং তাহার অভিঘাতে ক্ষমতাবান ক্লাবগুলির কর্তারা নূতন পরিকল্পনা হইতে পিছু হটিতে বাধ্য হইয়াছেন। তাঁহারা আপন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করিবার নূতন সুযোগ খুঁজিবেন না, তাহার কোনও নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু অন্তত এই পর্বে তাঁহাদের পরাজয় ও পশ্চাদপসরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফুটবলের পক্ষেও, সমাজের পক্ষেও।
ফুটবল নামক সর্বার্থে বহুত্ববাদী ক্রীড়াটির রোম্যান্সের মূলে আছে আচম্বিতে বিস্মিত করিবার ক্ষমতা। বিশ্বকাপে ক্যামেরুন ও সেনেগালের নিকট বিশ্বসেরা আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের পরাজয় ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে আজও অমলিন। ইউরোপীয় ফুটবলে যেটুকু সমানাধিকার এখনও টিকিয়া আছে, তাহা কেবল নৈতিকতার জন্য নহে, খেলার উৎকর্ষের স্বার্থেও সুরক্ষণীয়। ফুটবল দর্শকের মনোরঞ্জনে বাঁচিয়া থাকে, কতিপয় ধনী সংগঠকের লাভের অঙ্কে নহে। খেলায় প্রতিযোগিতার অবারিত সুযোগ না থাকিলে অনুপ্রেরণা হারাইয়া যায়, অনামাদের তো বটেই, বিশ্বসেরারও। খেলাকে যদি রক্তমাংসে জীবিত রাখিতে হয়, তাহা হইলে সমৃদ্ধির সুযোগ দিতে হইবে প্রতিটি উপকরণকে— ক্লাব প্রেসিডেন্ট হইতে প্রশিক্ষক, সমর্থক হইতে ফুটবলারের পরিবার। এই বার সেই সমগ্র সমাজই প্রতিবাদে মুখর হইয়াছে। ফুটবলের অস্তিত্ব সেই ভালবাসাতেই বাঁচিয়া আছে। উহাই ফুটবলের ধন।