West Bengal Panchayat Election 2023

গণতন্ত্রের পথরেখা

পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় সব পক্ষেই হিংসার প্রকোপ সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফলে গণতন্ত্রের একটি ক্ষীণ রেখা দৃশ্যমান। ক্ষীণ হলেও তা আশাজনক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩ ০৪:৩৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা বরাবরই সময়সাপেক্ষ। এ-বারেও সেই নিয়মের ব্যত্যয় হওয়ার কারণ ছিল না। প্রথম পর্বে যা পাওয়া গিয়েছে, সেটি সামগ্রিক প্রবণতার ছবি। সেই ছবির দু’টি স্তর। একটি তার উপরিতল। সেখানে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পরিব্যাপ্ত সাফল্য। স্থানীয় প্রশাসনের তিনটি স্তরেই পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ এলাকায় তাদের সামগ্রিক আধিপত্য বজায় থাকবে, এমন সম্ভাবনা জোরদার। ইতিমধ্যেই, বস্তুত ভোট গণনার কাজ কয়েক পা এগোতে না এগোতেই শাসক দলের সর্বস্তরে— কেবল সতত-উদ্বেল কর্মী-বাহিনী নয়, উচ্চ থেকে উচ্চতর নায়কনায়িকাদের মহলেও— জয়ধ্বনির যে শোরগোল ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তা এই আতিশয্য-প্রবণ বঙ্গসমাজেও কিঞ্চিৎ কানে লাগতে পারে। সংশয় হতে পারে, সাফল্য তো মোটের উপর প্রত্যাশিতই ছিল, তা হলে সাতসকালে ‘আমরাই জয়ী’ বলে পাড়া মাথায় করবার এমন ব্যগ্রতা কেন?

Advertisement

এখানেই নিহিত আছে নির্বাচনী ফলাফলের দ্বিতীয় স্তর, তার গভীরতর তাৎপর্য। তাকে বলা চলে বিরোধী রাজনীতির পুনরুত্থান। ভোটের আগেই তার একটি লক্ষণ দেখা গিয়েছিল: ২০১৮ সালের তুলনায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় (শাসক দলের প্রার্থীদের) জয়ের অনুপাত এ-বার অনেকটাই কম। ভোটের ফলাফলেও ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট যে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাত্রা বেড়েছে, কিছু কিছু অঞ্চলে লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে। আসনসংখ্যার তালিকায় তার কিছু কিছু প্রতিফলন ঘটেছে, তবে আরও বেশি অর্থপূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে বিরোধীদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। এবং, সেই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয় যে, বিরোধী শিবিরে একাধিক দল বা জোট প্রতিস্পর্ধী পরিসর দাবি করছে, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ‘বাইনারি’ বা দ্বৈত বিভাজনে ভাগ হয়ে যাচ্ছে না, বহুদলীয় প্রতিযোগিতা নিজের পুনরুজ্জীবন ঘোষণা করছে। তার ফলে বিরোধী ভোট বিভাজন ঘটতে পারে, পরিণামে আসনসংখ্যার বিচারে শাসক দলের বাড়তি সুবিধা হতে পারে, কিন্তু বিরোধী পরিসরে বহুদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদি বিচারে গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ ও আশাপ্রদ।

গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধা এবং তার বহুত্বের প্রত্যাবর্তন সহজ ছিল না। ছলে বলে কৌশলে, বিশেষত প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিরোধী দলের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার সেই ট্র্যাডিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্ব থেকে শুরু করে চলমান গণনাপর্ব অবধি অব্যাহত। বস্তুত, ভোটের লড়াইকে আক্ষরিক অর্থে সর্বগ্রাসী যুদ্ধে পরিণত করে দেশকে বিরোধী-শূন্য করবার প্রকল্পে কেন্দ্রীয় শাসকদের যে অসহিষ্ণু একাধিপত্যের প্রকাশ, রাজ্যের শাসকদের কার্যকলাপেও তার প্রতিবিম্ব। তাঁদের আচরণ দেখে বারংবার মনে হয়েছে, তাঁরা স্বাভাবিক সাফল্যে সন্তুষ্ট নন, সব এলাকায় সব ভোট তাঁদেরই দখল করতে হবে। বিরোধী পরিসরটিকে মর্যাদা দিলে যে শাসনের যথার্থ বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি বিচারে শাসক শিবিরের স্বাস্থ্যও সুরক্ষিত থাকে, এই বোধ ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাবতীদের নেই, অথবা থেকেও নেই। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও তারই পরিচয় মিলেছে। এই পরিস্থিতিতেও বিরোধী রাজনীতি যে অন্তত আংশিক ভাবে ফিরতে পেরেছে, শাসকরা সেই সত্য উপলব্ধি করেছেন বলেই কি কালবিলম্ব না করে জয়ধ্বনি ঘোষণার এমন তৎপরতা? এ প্রশ্নের উত্তর তাঁরাই জানেন। তবে এই সত্যটুকু পশ্চিমবঙ্গের বিধ্বস্ত গণতন্ত্রের পক্ষে কিঞ্চিৎ ভরসার কারণ। সেই ভরসাকে সত্য করে তুলতে চাইলে বিরোধীদেরও অতঃপর অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। হিংস্রতা এবং বিদ্বেষের প্ররোচনা দেওয়া অথবা তার দ্বারা প্ররোচিত হওয়ার পথ বর্জন করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলন না করলে পশ্চিমবঙ্গের গভীর সঙ্কট কাটবে না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় সব পক্ষেই হিংসার প্রকোপ সত্ত্বেও নির্বাচনের ফলাফলে গণতন্ত্রের একটি ক্ষীণ রেখা দৃশ্যমান। ক্ষীণ হলেও তা আশাজনক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement