রেডিয়ো, টিভি, সিনেমা ইত্যাদি জনসংস্কৃতির উপকরণ ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বদলে দেয়।
আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা।” ছাপার অক্ষরে এই বাক্যগুলি পড়েও কানের কাছে, স্মৃতিতে বেজে ওঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতার আগে শুরু হওয়া প্রভাতী রেডিয়ো অনুষ্ঠানের আবেদন রেডিয়ো-যুগ পেরিয়ে টিভি, ইউটিউবে এখনও অটুট। অনুষ্ঠানটির নাম যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, বাঙালি কবেই ভুলে গিয়েছে। বরং পিতৃপক্ষের শেষ তিথি, মহালয়া অমাবস্যা আর এই বেতার অনুষ্ঠান অদ্বৈত হয়েছে বাঙালির গণচেতনায়। মহালয়া বললে আম-বাঙালি এখন আর কোনও বিশেষ তিথি বোঝে না। বোঝে ওই তিথিতে ভোর চারটের এক বেতার-অনুষ্ঠান। যেখানে উদাত্ত চণ্ডীপাঠের পাশাপাশি কখনও সুপ্রীতি ঘোষের সুরেলা আবাহন, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’, কখনও বা দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়: ‘জাগো দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী’। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে উঠবে, দিনের প্রথম যানবাহনের শব্দ পাওয়া যাবে, কেউ কেউ তার একটু পরেই পিতৃপুরুষের তর্পণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বেন। পাড়ার প্রতিটি বাড়ি থেকে ইথারতরঙ্গে ভেসে আসবে শেষ পর্যায়ের চণ্ডীপাঠ। বাঙালির পুজো শুরু সে কালের এক বেতার অনুষ্ঠান থেকে। এটাই ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না এমন এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ।’
কেউ কেউ কূট তর্ক তুলতে পারেন, ইটালির মার্কনি সাহেবের আবিষ্কৃত যন্ত্রটি না থাকলে বাঙালির এই মহালয়া-ঐতিহ্য তা হলে থাকত না? এক কথায় উত্তর, না। রেডিয়ো, টিভি, সিনেমা ইত্যাদি জনসংস্কৃতির উপকরণ ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বদলে দেয়। ‘সন্তোষী মা’ নামে এক দেবী আমাদের জীবনে পঞ্চাশ বছর আগেও ছিলেন না, প্রতি শুক্রবার কেউ তাঁর ব্রতকথা পাঠ করে ছোলা-গুড় খেতও না। কিন্তু সিনেমার প্রভাবে তিনি হয়ে উঠলেন আরাধ্যা। তারকেশ্বরের দুধপুকুর ছিল, পল্লীসমাজ উপন্যাসে রমেশ আর রমার সেখানে স্নানশেষে দেখাও হয়েছিল। কিন্তু রমা কাঁধে বাঁক নিয়ে মানত পূরণে গিয়েছিল কি না, সে বিষয়ে শরৎচন্দ্র কিছু বলেননি। সত্তরের দশকে সিনেমায় সন্ধ্যা রায় বাঁক কাঁধে, দণ্ডী না কাটলে কি ‘বাবা তারকনাথ’ এত জনপ্রিয় হতেন? রামায়ণ, মহাভারত বহু কাল ধরেই এ দেশের মহাকাব্য। কিন্তু রামানন্দ সাগরের সিরিয়াল যখন সম্প্রচার হত, হিন্দি বলয়ের অনেক জায়গায় ‘রাম’ অরুণ গোভিল আর ‘সীতা’ দীপিকা চিকলিয়াকে দেখার জন্য লোকে টিভির সামনে করজোড়ে, তুলসীদাসের শ্রীরামচরিতমানস ছুঁয়ে বসে থাকত। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি আন্দোলনের পিছনে আডবাণীর রথযাত্রা, দেশ উজাড় করে রামশিলা যাওয়া ইত্যাদি অনেক কিছু ছিল। কিন্তু তৎকালীন জনমানসে ওই সিরিয়ালও ছিল। সকাল ন’টায় সম্প্রচার শুরুর আগে রাস্তাঘাট বাজারহাট ফাঁকা। অন্ধ্রপ্রদেশে এন টি রাম রাও-কে দেখতে পেলেই যে আবালবৃদ্ধবনিতা ঈশ্বরদর্শনের অনুভূতিতে টপাটপ প্রণাম করতেন, তার কারণই তো সিনেমা। তেলুগু ছবিতে বিভিন্ন ঐশ্বরিক চরিত্রে অভিনয় করতে করতে ভক্তদের কাছে তখন এনটিআরও প্রায় ঈশ্বর। তাঁর তৈরি সদ্যোজাত তেলুগু দেশম পার্টিই তো তাই তৎকালীন কংগ্রেস, জনতা সবাইকে ভোটে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করবে। ধর্ম মানে অনড় সনাতন কোনও ঐতিহ্য নয়, জনবিশ্বাসের একটি প্রথা। লোকবিশ্বাসের এই প্রথাটি জনতার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সঙ্গে তাল রেখে নিজেকে বদলে নেয়, এই চলিষ্ণুতাই তার মাহাত্ম্য।
হিন্দুর ধর্মমাহাত্ম্য বহুবিধ। একদা চার ধাম বলতে কেদার, বদ্রী, রামেশ্বর ও দ্বারকাকে বোঝাত। লোকের হাতে সময় ছিল, সারা ভারত পদব্রজে যেতেও অসুবিধা ছিল না। এখন সেই চার ধাম সীমানা ছেঁটে শুধু কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রীর গাড়োয়াল অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। ইউরোপীয়রা যদি না আসত, কম্পাস ও মানচিত্র নিয়ে পর্বত অভিযানে না যেত, গঙ্গা বা যমুনার উৎস কী ভাবে জানা যেত? পাঁচালি থেকে রেডিয়ো-নাটক-সিনেমা-বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ইত্যাদি জনসংস্কৃতি যা অক্লেশে ধারণ করে, তারই নাম ধর্ম। কথাটা আদালত অবধি মানে। রাম নামে আদৌ যে কেউ ছিলেন, অথবা অযোধ্যাতেই যে তাঁর জন্ম হয়েছিল, এর কি কোনও তথ্যপ্রমাণের প্রয়োজন হয়েছে? শীর্ষ আদালতও তো দিব্য মানুষের বিশ্বাসকেই মেনে নিল।