সংসদ। —ফাইল চিত্র।
আধার কার্ডের দেশজোড়া যজ্ঞ শেষ হতে না হতেই আরও একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হল ভারতে: জন্ম মৃত্যু নথিভুক্তিকরণ বিল পাশ হল। মূল আইনটি ছিল ১৯৬৯ সালের: নতুন সংশোধনের ফলে এখন থেকে জন্মের সার্টিফিকেট আবশ্যিক নথি হিসাবে দেখানো নিয়ম হয়ে গেল বহু ক্ষেত্রে। বিষয়টি শুনতে স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হতে চলেছে, সেই তালিকার দিকে তাকালে সন্ত্রস্ত বোধ করতে হয়। তালিকাটি বেশ দীর্ঘ, বিদ্যালয়ে কিংবা উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, ভোটার লিস্টে নাম তোলা, সরকারি চাকরিতে আবেদন করা, বিবাহ, পাসপোর্ট আবেদন, প্রায় সর্ব রকম সরকারি সহায়তার ক্ষেত্র ইত্যাদি। এবং প্রাথমিক ভাবে এই সার্টিফিকেট-এর জন্য লাগবে বাবা ও মায়ের আধার কার্ড। এই ভাবে একটি ‘ডেটা-বেস’এর মধ্যে দেশের সকল মানুষের অন্তর্ভুক্তিই এই নতুন সংশোধনীর লক্ষ্য। আপাত ভাবে মনে করা হচ্ছে, এর ফলে যে কোনও ধরনের সরকারি প্রকল্প ও সামাজিক সহায়তা লাভ সহজ হয়ে যাবে। এই ‘আপাত’ যুক্তিটি অবশ্য রীতিমতো বিতর্কিত। সত্যিই সরকার ও নাগরিকের সম্পর্ক এর ফলে সহজ হয়ে যাবে, না কি কঠিন, এমনকি কঠিনতর হবে, তা শেষ পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
রাজনৈতিক প্রশ্ন, কেননা আধার কার্ড পর্যায়েই সম্ভবত পর্যাপ্ত ভাবে বোঝা গিয়েছে যে ভারতের মতো দরিদ্র দেশ নথির দিক থেকেও কতটা দরিদ্র। এমন এক দেশে কেবল একটিমাত্র নথির উপর নাগরিকের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই সর্বব্যাপী আবশ্যিক নির্ভরতা দরিদ্র জনসমাজের কাছে ভয়ঙ্কর বিপদে পরিণত হতে পারে। এই নথিভুক্তি যেমন কোনও ব্যক্তির জীবন থেকে মৃত্যু সমস্ত ঘটনা সরকারের খাতায় লিপিবদ্ধ হতে সাহায্য করবে, তেমনই নথি কোনও কারণে না থাকলে তা নাগরিককে সম্পূর্ণ অসহায়তায় নিক্ষেপ করবে, সম্ভবত নাগরিক পরিচয়ই অর্জন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। শহরের মসৃণ জীবনে বসে হয়তো কল্পনা করাও কঠিন, পিতামাতা বা অভিভাবকের আধার কার্ড ভিত্তিক শিশুজন্মের সময়, স্থান ও পরিচয় সম্বলিত একটি সরকারি নথি আবশ্যিক করার সঠিক অর্থটি কী। কেবল মানুষের অসচেতনতা, দারিদ্র, অশিক্ষা বা অপারগতাই সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করবে না, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিকূলতাও বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিতে পারে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে অরুণাচল এই ব্যবস্থা মোতায়েন করার জন্য যে বিপুল সরকারি পরিকাঠামো লাগে, তা দেশের সর্বত্র পাওয়া যাবে তো? সরকারি কর্মীরা দক্ষ ও নৈতিক ভাবে কাজ করবেন তো? এত দিন সামান্য সরকারি সহায়তা পেতেই যে লাল ফিতের বাধা, এবং কালো আদানপ্রদানের চক্র পথ জুড়ে বসত, তেমন ভাবেই আবার এই নথিও মানুষের অধিকারের পথে আর একটি বাধা হয়ে বসবে না তো?
সুতরাং, আপাতত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে প্রশ্ন রাখা দরকার যে, এই সংস্কারের পিছনে মূল ভাবনাটি যদি নাগরিকের জীবনে তেমন বাধা তৈরি করা না হয়, তা হলে জন্ম-মৃত্যু নথিভুক্তিকরণের এই প্রকল্প মাথায় রেখে এখনই বড় মাপের প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা জরুরি। মনে রাখা ভাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে, নাগরিক পঞ্জি থেকে শুরু করে আধার কার্ড, সবেতেই নাগরিক কিন্তু ওষ্ঠাগত বোধ করেছেন, নিরাপত্তার নামে অধিকার-রোধেরই হাজারো পন্থা তৈরি হয়েছে। এ বারও তেমন হবে, এই সংশয়কে ভিত্তিহীন বলা মুশকিল। সংশয়টিকে দূর করার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র দফতর তথা কেন্দ্রীয় প্রশাসনেরই। নাগরিকের অধিকারভঙ্গের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর— তাই মনে রাখতে হবে, সংশয় দূর করার দায় পালনে কেন্দ্রীয় সরকারের সামান্য স্খলনও কিন্তু বিপুল পরিমাণ অসহায় সাধারণ মানুষকে আরও বড় অসহায়তা ও অনধিকারের সাগরে ডুবিয়ে দিতে পারে।