বর্ষবরণের রাত থেকে নতুন বছরের প্রথম রাত— ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র পিজি-র ট্রমা কেয়ারে নিয়ে আসা হয়েছে ১৬৫ জন পথ-দুর্ঘটনায় আহতকে। ফাইল ছবি।
কলকাতা শহরের একটি আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। উৎসবের দিনে উচ্ছৃঙ্খলতা সংক্রান্ত যাবতীয় আশঙ্কা, উদ্বেগ নির্ভুল প্রমাণের ক্ষমতা। বড়দিনের ভিড়ের বহর, এবং উন্মত্ত আমোদ দেখে সম্পাদকীয় কলমেই বর্ষবরণ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল (‘বেলাগাম’, ৩০-১২)। তা মর্মান্তিক ভাবে সত্য প্রমাণিত। বর্ষবরণের রাত থেকে নতুন বছরের প্রথম রাত— ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র পিজি-র ট্রমা কেয়ারে নিয়ে আসা হয়েছে ১৬৫ জন পথ-দুর্ঘটনায় আহতকে। অস্ত্রোপচার হয়েছে ২৫ জনের। অতি সঙ্কটজনক অবস্থায় আছেন ৯ জন। এবং বছরের প্রথম দিনটিতেই নিউ টাউনের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় ক্যাম্পাসের সামনে পথ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ, বড়দিন, বর্ষবরণ কোনও অত্যাশ্চর্য ঘটনা নয়। কালের নিয়মেই পুরনো বছর বিদায় নেয়, নতুন বছর নতুন আশা নিয়ে তার যাত্রা শুরু করে। সেই যাত্রার শুরুই যদি এমন বিশৃঙ্খল, বিকট হয়, তবে আগামী দিনগুলির জন্য বিন্দুমাত্র আশা বেঁচে থাকে কি?
স্তম্ভিত করে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাও। উৎসব-অন্তে প্রথামতো লালবাজারের তরফ থেকে নিয়মভঙ্গকারীদের কত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বা কত জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কত জন পুলিশের সামনেই অন্যায় করে, নিয়ম ভেঙে পার পেয়ে গিয়েছেন, সেই সংখ্যাটি প্রকাশ্যে আনা হয়েছে কি? যে শহরের অলি-গলিতে মত্ত বাইকচালকরা দাপট দেখায়, পুলিশের সামনেই ট্র্যাফিকবিধি ভাঙার হিড়িক পড়ে, সে শহরে কত জনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা করা সম্ভব? না কি, পরিসংখ্যান শুধুমাত্র প্রবোধ দেওয়ার জন্যই ব্যবহৃত হয়? প্রশ্ন রয়ে গেল, ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটা পার হতেই যে বিপুল পরিমাণ শব্দবাজি শহর জুড়ে দাপিয়েছে, তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থার সদিচ্ছা নিয়েও। প্রতি বছর কালীপুজো, ছট থেকে বর্ষবরণ— শব্দবাজির তাণ্ডব সীমা ছাড়ায়। পুলিশের উচিত, শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়া। তা হলে অন্তত উৎসবের আগে ধরপাকড়ের ভণ্ডামি থেকে নিষ্কৃতি মেলে। অবশ্য, এ বঙ্গে নেতাদের ‘অনুরোধ’, ‘তর্জনগর্জন’-এর ঠেলায় স্বয়ং পুলিশকেই কখনও কখনও অভিযুক্তদের গালাগালি, মার বেমালুম হজম করতে হয়। তাই, প্রশাসনের শীর্ষ স্তর যেখানে ‘দুষ্টুমি’তে সস্নেহ প্রশ্রয় জোগায়, পুলিশের একার সাধ্য কী তার অন্যথা করার।
এও ঠিক, প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক যথেচ্ছাচার করবে, আর পুলিশ তাদের সহবত শেখাবে, এমত ভাবনার মধ্যেও এক ধরনের সাংস্কৃতিক দৈন্য আছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ এখনও শেষ হয়নি, সেই পরিপ্রেক্ষিতেও যদি নাগরিক কাণ্ডজ্ঞানের উদয় না হয়, তবে তা যথেষ্ট আশঙ্কার। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই উৎসব পালিত হল, এবং কোভিড-পর্ব সে সব দেশেও সামাজিক জীবনে দীর্ঘ যতি টেনেছিল। খবর নেওয়া যেতে পারে, কতগুলি দেশে একটি উৎসবকে ঘিরে এ-হেন পরিস্থিতি সৃষ্ট হয়েছে, যেখানে সরকারি হাসপাতালগুলির ট্রমা কেয়ারের বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা সামলাতে চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হবে? কেবলমাত্র কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলেই কি দু’বছরের গৃহবন্দি থাকার কষ্ট দেদার অ-সভ্যতাকে ছাড়পত্র দেয়? আত্মসমীক্ষা জরুরি।