—প্রতীকী ছবি।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নেশা উত্তরোত্তর মাথায় চড়ে বসে, বেড়ে চলে ক্ষমতাবানদের উপদ্রব। ভারতের বর্তমান শাসকদের উপদ্রবের এক বড় হাতিয়ার হল সরকারি গোয়েন্দা বাহিনী। বিরোধী রাজনীতিকরা তো এখন তার পাইকারি নিশানায় পরিণত, কিন্তু গোয়েন্দাদের কর্মক্ষেত্র ক্রমশ আরও প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি শোনা গিয়েছে দিল্লির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো-র প্রতিনিধিদের তৎপরতার সংবাদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইবি-র ঘোরাঘুরি হয়তো সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব নয়, কিন্তু স্থানকালপাত্রের সমন্বয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাটি গভীর উদ্বেগের কারণ। এই প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষকের একটি গবেষণাপত্রে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতে শাসক দলের অনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এমন প্রশ্নে দিল্লীশ্বরদের রুদ্ররোষ উৎপন্ন হয়। অতঃপর ওই শিক্ষক-গবেষক যে ভাবে আক্রান্ত ও বিব্রত হয়েছেন, সেটাই যথেষ্ট বিবমিষা উদ্রেক করেছিল। কিন্তু ক্ষমতার নেশা সেখানে নিরস্ত হয়নি, এমন ‘আপত্তিকর’ গবেষণার বিষয়ে ‘খোঁজখবর’ করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আইবি-র গোয়েন্দারা নাকি সটান বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হয়েছেন। প্রথম দফায় তাঁরা দৃশ্যত জল মেপে এসেছেন, হয়তো ক্রমে ক্রমে জলে নামবেন।
স্পষ্টতই, গোয়েন্দা বাহিনী তথা তাঁদের নেপথ্য-চালকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষক গবেষক ছাত্রছাত্রীদের ভয় দেখাতে চান, যাতে তাঁরা শাসকের প্রতিকূল কোনও কথা না বলেন, তাঁর বিরাগভাজন কোনও কাজ না করেন। ভয় দেখিয়ে করব শাসন— এটাই তাঁদের ধর্ম। কার্যত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই দেশের অগণন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদী ও প্রশ্নবাচী কণ্ঠস্বর দমন করে রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বিস্তারের যে ধারা এই
শাসকরা প্রবর্তন করেছেন, দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়টির সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তারই সাম্প্রতিকতম নজির। দুনিয়া জুড়ে ‘অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম’ বা বিদ্যাচর্চার স্বাধীনতার হাল সম্পর্কে ইউরোপের দু’টি গবেষণা সংস্থার এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে, ১৭৯টি দেশের মধ্যে ২২টিতে গত এক দশকে স্বাধীনতার মাত্রা কমেছে। ভারত তাদের অন্যতম। তালিকায় ভারতের স্থান পিছনের সারিতে, সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশের মধ্যে। চিনের আসন সর্বনিম্ন ১০ শতাংশের সারিতে। গোয়েন্দাদের তৎপরতায় ভারত বোধ করি অচিরেই চিনের সমকক্ষ হবে।
স্বাধীনতার মাপকাঠি কী? কোন কোন ক্ষেত্রে অবাধে কাজ করার সুযোগ থাকলে মনে করা হবে যে বিদ্যাচর্চার স্বাধীনতা আছে? পূর্বোক্ত সমীক্ষাটিতে দেখা হয়েছে পাঁচটি বিষয়: গবেষণা ও শিক্ষকতা, গবেষক ও শিক্ষকদের পারস্পরিক আদানপ্রদান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধিকার, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির অবাধ চর্চা ও অনুশীলনের সুযোগ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে মুক্ত বাতাবরণ, অর্থাৎ— ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক নিরাপত্তার পরিবেশ আছে কি না এবং সেখানে কোনও নজরদারি চালানো হয় কি না। বলা বাহুল্য, গোয়েন্দাদের উৎপাত এই শেষ শর্তটিকে সরাসরি লঙ্ঘন করে, সেই কারণেই দিল্লির সাম্প্রতিক ঘটনাটি অতিমাত্রায় উৎকট। কিন্তু অন্য প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই গত এক দশকে রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে বা প্রত্যক্ষ পরিচালনায় বিদ্যায়তনের স্বাধীনতাহানির অজস্র নজির তৈরি হয়েছে। বিশেষত, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংস্থানের মেরুদণ্ডটি ভেঙে দিয়ে বা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তাদের বশে আনার অপচেষ্টার ভূরি ভূরি অভিযোগ শোনা গিয়েছে। একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, দিল্লির সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়টির বিদেশি অনুদান সংক্রান্ত সরকারি অনুমোদন পুনর্নবীকরণের লগ্ন সমাসন্ন। ঠিক তার আগেই গোয়েন্দাদের সফর— নিতান্তই সমাপতন, না কি এক নতুন বিপদসঙ্কেত? অসহিষ্ণু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের মত্তহস্তী অতঃপর সরাসরি বিদ্যাচর্চার কমলবনে দাপাদাপি করবে?