মোহন ভাগবত। ছবি: পিটিআই।
অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য নিরাপত্তার অভাবে নিরন্তর পর্যুদস্ত হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত যদি হাতে হাত এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দরবারে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করেন, “অযোধ্যা নগরীতে চকমিলানো নতুন মন্দিরখানি আমাদের কী কাজে লাগবে”, উত্তর পাবেন না, পাবেন কঠোর তিরস্কার। রামলালার ‘স্বগৃহে’ প্রত্যাবর্তনের পরমানন্দ যাঁদের দৈনন্দিন ক্ষুধাতৃষ্ণাকে হরণ করতে পারে না, সঙ্ঘ পরিবারের রাজত্বে তাঁদের জন্য কেবল তিরস্কার নয়, রকমারি শাস্তিও বরাদ্দ হতে পারে। নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থরা যে নতুন ভারত গড়তে বদ্ধপরিকর, সেখানে সবার উপরে হিন্দুত্ব সত্য, তাহার উপরে নাই। অতএব, বিজয়া দশমী তথা দশেরার দিনে সঙ্ঘের প্রধান ঘোষণা করেছেন যে আগামী ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরের দরজা খুলবে এবং সরকারের প্রধান জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী রামনবমী পালিত হবে নতুন মন্দিরে। নির্ধারিত দিনক্ষণ অবশ্য এর আগেই জানা গিয়েছিল, কিন্তু রাবণ বধের তিথিতে মোহন ভাগবত এবং নরেন্দ্র মোদীর যুগলবন্দিতে সেই নির্ঘণ্ট যে ভাবে প্রচারিত হল, তার তাৎপর্য জলবত্তরলম্।
স্পষ্টতই, এ হল শাসক শিবিরের নির্বাচনী প্রচার। সেই প্রচারের প্রধান লক্ষ্য অবশ্যই আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচন, কিন্তু তার আগে অন্তত পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ‘সেমি ফাইনাল’ পর্বও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সর্বভারতীয় এবং প্রাদেশিক, দু’টি স্তরেই ভোটের হিসাবনিকাশ নিয়ে বিজেপির নানা সমস্যা আছে, দুশ্চিন্তাও কম নয়। এই অবস্থায় শাসকদের পক্ষে একটি আবেগের রাজনীতি সওদা করার তাগিদ অত্যন্ত প্রবল। রামমন্দির সেই রাজনীতির হাতিয়ার। কেবল উত্তর ও পশ্চিম ভারতের তথাকথিত হৃদয়পুরে নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ‘অখণ্ড’ হিন্দুত্বের মোহজালটিকে বিস্তার করার অভিযানে এই মন্দির একটি বড় প্রকরণ। রামমন্দিরের নির্মাণ, স্থাপত্য ও বিন্যাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপকরণ, শৈলী এবং ধর্মাচরণকে যে ভাবে স্থান দেওয়া হয়েছে, তার পরতে পরতে একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য সুস্পষ্ট, যার নাম অখণ্ড হিন্দুস্থান। এতদ্দ্বারা রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ধারক ও বাহকরা সংখ্যাগুরুতন্ত্রের আধিপত্যকে জোরদার করে তুলতে চান।
আশির দশক থেকেই বিজেপি এই তন্ত্রের সাধনা করে এসেছে। কঠিন সাধনা। জাতপাতের বহুমাত্রিক বিভাজনে বিদীর্ণ ভারতীয় সমাজকে কোনও অখণ্ড সত্তার কাঠামোয় বাঁধা কোনও দিনই সহজ ছিল না। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের জমানায় সেই সামাজিক বিভাজন সরাসরি রাজনীতির পরিসরে স্থান নেওয়ার পরে শুরু হয় ‘মণ্ডল বনাম কমণ্ডলু’-র ঐতিহাসিক টানাপড়েন, যে টানাপড়েন এখনও প্রবল। সংখ্যালঘুকে ‘শত্রু’ প্রতিপন্ন করে এবং ‘সনাতন’ ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের আবেগ সঞ্চার করে সঙ্ঘ পরিবার তার অখণ্ড হিন্দুত্বের ছত্রটিকে উত্তরোত্তর প্রসারিত করতে তৎপর, কিন্তু জাতপাতের জটিল অঙ্কগুলি ক্রমাগত সেই ছাতাকে বেসামাল করে চলেছে— কেবল উচ্চবর্ণ, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি ও দলিতের পারস্পরিক সংঘাত নয়, এই প্রত্যেকটি বর্গের অন্দরে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। এই কারণেই বিজেপি জাতগণনার দাবিটিকে প্রতিহত করতে চায়— তারা জানে এই গণনা প্যান্ডোরার নতুন বাক্স খুলে দেবে। বিরোধী শিবিরেও, বিশেষত কংগ্রেসের মতো দলে, এই দ্বন্দ্বের নানা অভিঘাত প্রকট। তবে বিজেপির পক্ষেই সমস্যাটি জটিলতম, কারণ ‘অখণ্ডতা’ই তার মূল মন্ত্র। সেই মন্ত্রের মহিমা রক্ষায় রামলালাকে কত ভাবে এবং কতখানি কাজে লাগানো যায়, সেটাই আপাতত নরেন্দ্র মোদীর প্রধান চিন্তা। আর, রামা কৈবর্ত্ত এবং হাসিম শেখ? প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই মনে করেন যে, আগামী বছর সাধারণতন্ত্র দিবসে রামমন্দিরের দরজা সকলের জন্য খুলে দেওয়ার সুসমাচারেই তাঁরা ধন্য হবেন। এই ধারণা ঠিক না ভুল, তাঁরাই জানেন।