—প্রতীকী চিত্র।
সরকারি হাসপাতালে পেয়িং বেড থাকলে চিকিৎসকরা তা থেকে আয়ের অংশ পেতে পারেন, যদি হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা না-করার জন্য ভাতা (নন প্র্যাকটিসিং অ্যালাওয়েন্স) তাঁরা ছেড়ে দিতে রাজি থাকেন। সম্প্রতি এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার হাসপাতালে; আগেই চালু হয়েছিল এসএসকেএম-এ। নীতির প্রশ্নে ব্যবস্থাটির অন্তত দু’টি মাত্রা রয়েছে— এক, সরকারি হাসপাতালে পেয়িং বেড রাখা; এবং দুই, পেয়িং বেড থেকে প্রাপ্ত আয়ের ভাগ চিকিৎসকদের দেওয়া। সরকারি হাসপাতালের কিছু শয্যায় পয়সার বিনিময়ে রোগী ভর্তির রীতি বাম আমলে চালু ছিল। তার যুক্তি ছিল এই যে, সেই টাকায় ফ্রি শয্যার রোগীদের পরিষেবা দেওয়া হবে। সেই অনুসারে পেয়িং বেড-এর রোগীদের থেকে পাওয়া টাকা জমা পড়ত রোগী কল্যাণ সমিতিতে। যদিও পেয়িং বেড-এর সংখ্যা ছিল নগণ্য, তবু ২০১৪ সালে তৃণমূল সরকার পেয়িং বেড তুলে দিয়ে, সব শয্যা ফ্রি করে দেয়। সিদ্ধান্তটি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। দরিদ্রতম রোগীর কাছেও চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছনো নিশ্চয়ই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে কি কেবল গরিবই চিকিৎসা করান? বিভিন্ন সমীক্ষা দেখিয়েছে, মধ্যবিত্ত ও ধনীরাও যথেষ্ট সংখ্যায় সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা গ্রহণ করেন, তাঁদের ভাগে পড়ে চিকিৎসায় সরকারি ভর্তুকির একটি বড় অংশ। এটা রাজকোষের অপব্যয়। যে রোগীর খরচের সামর্থ্য রয়েছে, হয় সরাসরি তাঁর থেকে, না হলে বিমা সংস্থার থেকে, তাঁর চিকিৎসার ব্যয় আদায় করাই সরকারের কর্তব্য। নিখরচায় চিকিৎসা না পেলে যাঁরা চিকিৎসাহীন থাকবেন, সরকারি হাসপাতালের ফ্রি শয্যা কেবলমাত্র তাঁদের জন্য হওয়াই বিধেয়।
অতএব সরকারি হাসপাতালে কিছু পেয়িং বেড রাখার পক্ষে নীতিগত যুক্তি রয়েছে। কিন্তু তা থেকে আয়ের ভাগ সরকারি চিকিৎসকরা কেন পাবেন, তার যুক্তি বোঝা গেল না। হাসপাতালে একটি নির্দিষ্ট সময়, কিছু নির্দিষ্ট কর্তব্য সমাধা করার জন্য সরকারি চিকিৎসকেরা বেতন পান। সেই সময়ের বাইরে, এবং নির্দিষ্ট কর্তব্যের অতিরিক্ত কোনও কাজ করলে তাঁরা বাড়তি ভাতা পেতে পারেন, নচেৎ নয়। সরকারি হাসপাতালে আগত রোগীর খরচ কে বহন করছে, চিকিৎসকের কাছে সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। তিনি সব রোগীকে একই মনোযোগ ও সময় দিতে, একই মানের পরিষেবা দিতে দায়বদ্ধ। তা হলে কিছু রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তার কী করে বাড়তি টাকা দাবি করতে পারেন? অপর পক্ষে, পেয়িং বেড-এর রোগী যদি উপভোক্তার অধিকারের ভিত্তিতে সরকারি চিকিৎসকের কাছে বাড়তি সময় দাবি করেন, যদি নিখরচার রোগীদের টপকে আগে অস্ত্রোপচার দাবি করেন, চিকিৎসক তাঁদের কী উত্তর দেবেন? সরকারি হাসপাতালে ‘শেয়ার অব হসপিটাল ইনকাম স্কিম’ চালু করলে এক হাঁসজারু ব্যবস্থা তৈরি হয়, যেখানে ব্যয়ভার সবটাই সরকারের, কেবল আয়ের ভাগ চিকিৎসকের। কর্তাদের যুক্তি, এতে সরকারি চিকিৎসকেরা হাসপাতালের বাইরে রোগী না দেখে ভিতরেই দেখবেন। অর্থাৎ, বেতনের সঙ্গে উপরির ব্যবস্থাও করতে হবে সরকারকে। ফ্রি বেডের রোগীকে যখন ব্যান্ডেজ, ওষুধ, স্যালাইনের জন্য দোকানে ছুটতে হচ্ছে, তখন চিকিৎসকদের ‘রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প’ প্রাধান্য পাবে কেন, প্রশ্নটা সেখানেই।