কেন্দ্রীয় সরকারের ২০২০ সালে প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রথম থেকেই মৌলিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা শোনা গিয়েছিল। প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে ঠিক কী করতে চায়? এই প্রশ্নের উত্তর সরকারের কাছেও আছে কি? উত্তরটি সদর্থক হলে একটি জোরালো আপত্তি ও দাবি ওঠানো যেতে পারে। আর উত্তরটি নঞর্থক হলে বিশেষ ত্রাসের সঞ্চার হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০২০ সালে প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রথম থেকেই মৌলিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা শোনা গিয়েছিল বিভিন্ন রাজ্য সরকারের তরফে— যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ কেবল অন্যতম নয়, নেতৃস্থানীয়। গত দু’বছর লাগাতার এই আপত্তি ধ্বনিত হয়েছে কখনও সংসদে, অন্যান্য বিরোধী রাজ্যের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে, কখনও রাজ্যের পরিসরেই। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয়েছে এই নীতির যথাযথ মূল্যায়ন ও পর্যালোচনার জন্য— যাতে নাম রয়েছে কতিপয় সুনামী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের, যাঁদের কেউ কেউ বিদেশে অধ্যাপনা করেন। সেই রিপোর্ট জমা পড়েছে, এমনও একটি সংবাদ গত জানুয়ারিতে জানা যায়। কিন্তু সেই রিপোর্টে ঠিক কী ছিল, তা প্রকাশিত বা আলোচিত হয়নি। এমনকি কমিটিতে যে সদস্যরা আছেন বলে শোনা গিয়েছে, তাঁরা সত্যিই ‘আছেন’ কি না, কিংবা তাঁরা সকলেই মতামত জানিয়েছেন কি না, এ নিয়েও সংশয় যথেষ্ট। ইতিমধ্যে গত সপ্তাহে এল রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিকতম নির্দেশিকা— জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করা হোক।
অঙ্ক কষতে গিয়ে যখন মধ্যবর্তী কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে সোজা উত্তরে পৌঁছনো হয়, ধরে নেওয়া হয় কিছু গোঁজামিলের সম্ভাবনা রইল। তেমন গোঁজামিল কি এই ক্ষেত্রেও থেকে গেল? কেন জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে প্রকাশ্য সংবাদ ও আলোচনার আগেই এমন নির্দেশিকা পাঠানো হল? কেন বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের অন্তত সারাংশও জনপরিসরে পাওয়া গেল না? কেন মূল যে কারণগুলিতে প্রাথমিক আপত্তি উঠিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার, সেগুলির একটিরও অপসারণ না হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করার দিকে এগোনো হল? শিক্ষাক্ষেত্রে এত বড় ও মৌলিক পরিবর্তন যে শিক্ষানীতির প্রতিপাদ্য, তা নিয়ে এমন ছেলেখেলা করার অধিকার রাজ্য সরকারের হল কী করে? ফিরে আসা যাক গোড়ার প্রশ্নটিতে। সরকার জানে তো, শিক্ষানীতি নিয়ে তার অবস্থানটি ঠিক কী? যদি উত্তর সদর্থক হয়— তা হলে রাজ্যের জনসাধারণের কাছে তা স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল। কেননা এটি কেবল শিক্ষাব্যবস্থার খুঁটিনাটির প্রশ্ন নয়, দেশব্যাপী শিক্ষার খোলনলচে ও ভিত্তিপ্রস্তর সর্ব ক্ষেত্রেই বড় বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব। এমন প্রস্তাবের সামনে সরকারের সিদ্ধান্ত স্বৈরতান্ত্রিক হতে পারে না, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই তা নিতে হবে। আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দু’টি ন্যূনতম শর্ত— নাগরিকের কাছে সরকারের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা।
খোলনলচে ও ভিত্তিপ্রস্তরের কথা কেন উঠছে, বোঝার জন্য বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। গত সপ্তাহে ইউজিসি-র আরও একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে, যাতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক গণিত, যোগ, আয়ুর্বেদ-সহ বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যক্রম যোগের কথা বলা আছে। কোন অভিমুখে যাত্রা, নতুন করে বলার দরকার নেই। তবে কি না, এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, কিছু কিছু রাজ্য তাদের পছন্দ-অপছন্দের তালিকা জানিয়ে তদনুসারে পদক্ষেপ করতে চেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিন্তু সেই পথটিও নেয়নি। চার বছরের স্নাতক পাঠ্যক্রমের দোষগুণ বিবেচনা, এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পরিকাঠামো না থাকলে তার কী ব্যবস্থা হতে পারে, সেই আলোচনা— এ সবের বদলে রাজ্য সরকার বলে দিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিজেরা কার্যক্রম স্থির করুক। এই অবিবেচনা এবং অস্থিরচিত্ততা দিয়ে কি শিক্ষার মতো জরুরি ক্ষেত্রে সংস্কার হতে পারে? রকমসকম দেখে মনে হওয়ার বিস্তর কারণ যে, রাজ্য সরকার ঠিক কী চায়, তার উত্তর মন্ত্রী-নেতাদের কাছেও নেই। পরিস্থিতি ভয়াবহ।