রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
বাঙালির— না কি বাংলার— অতি দুর্নিয়তি যে এই মুহূর্তে দেশভরা হাজারো গভীর সঙ্কটের মধ্যে আরও একটি অকারণ সঙ্কটে তাকে ফেলা হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় চলচ্চিত্র উৎসবের সরকারি সূচনায় একটি বহুশ্রুত, বহুবন্দিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের শব্দ বদল করে গীত হওয়ার পর থেকে রাজ্য জুড়ে বেদনার্ত প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদদেরও নিশ্চয় জানা ছিল যে, বাংলার মাটি বাংলার জল-এর মতো গানে ‘বিকৃতি’ ঘটালে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে। বাস্তবিক, আগে যখন তিনি এই ‘প্রস্তাব’ উচ্চারণ করেন, তখনই পশ্চিমবঙ্গবাসীদের অনেকেই এ নিয়ে জোরালো মত প্রকাশ করেছিলেন, জনপরিসরে বেশ স্পষ্ট ভাবে এই প্রস্তাবের নিন্দা করা হয়েছিল। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও লেখা হয়েছিল যে এমন কোনও প্রস্তাব দেওয়া বা চিন্তা করাই ‘অনুচিত, অনৈতিক এবং বিপজ্জনক’ (১ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। বলা হয়েছিল যে সরকারি ক্ষমতা হাতে আছে বলেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে এই ‘খেয়ালখুশির তাণ্ডব’ করা চলে না। স্পষ্টত, এ সব কোনও কথাই ‘সর্বময়ী’ নেত্রীর মর্মে প্রবেশ করেনি, তিনি এত দিনে ‘যা ইচ্ছা তাই করা’-কে একটি স্বাক্ষরে পরিণত করে চলেছেন।
‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির আশা’, বা ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন’ পংক্তিগুলিতে ‘বাঙালির’ শব্দটিকে ‘বাংলার’ করে দেওয়া হচ্ছে যে যুক্তি দেখিয়ে, সেটি হাস্যকর এবং অর্বাচীন। হাস্য উদ্রেক হয় গান কিংবা কবিতার শব্দের মূল অর্থ না বুঝে এমন শব্দভিত্তিক সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যার অবোধ অর্বাচীনতা দেখে। নিতান্ত নির্বোধ না হলে গানটি পড়লেই বোঝা যায় যে সঙ্গীতরচয়িতা মহাশয় এখানে কোনও প্রাদেশিকতার বশবর্তী হয়ে পড়েননি, বরং তিনি বাংলার সকল অধিবাসীর প্রতি উদ্দেশ করে কথাগুলি বলেছিলেন। ১৯০৫ সালে বাংলার এক সঙ্কটকালে স্বদেশের এক গভীর দ্যোতনা নিয়ে গানটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলার সকলকে নিয়ে চলার কথাই তিনি বলেছিলেন, গানটির খণ্ড খণ্ড শব্দের বদলে সমগ্র ভাবটিতে মন দিলে সহজে তা বোঝা সম্ভব। যাঁরা বুঝতে পারবেন না, তাঁদের রবীন্দ্র রচনাবলি খুলে এইটুকু দেখিয়ে-পড়িয়ে দেওয়া যেত যে, ১৯৩৯ সালে মহাজাতি সদনে গানটি স্বকণ্ঠে গাইবার সময় কবি বলেছিলেন ‘‘আমরা বাংলাজাতির যে শক্তি প্রতিষ্ঠা করবার সঙ্কল্প করেছি তা সেই রাষ্ট্রশক্তি নয় যে শক্তি শত্রু মিত্র সকলের প্রতি সংশয়-কণ্টকিত। জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করি, যার সংস্কারমুক্ত উদার আতিথ্যে মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি অকৃত্রিম সত্যতা লাভ করে।’’ এই ‘উদার আতিথ্য’-এর আবেদন, বিশেষ ভাবে এই ঐতিহাসিক গানটিতে, এবং সাধারণ ভাবে, রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত রচনার মধ্যে প্রবাহিত মূল বাণী। সেই ভাব ও ভাবনাকে এমন সঙ্কীর্ণ ভাবে বাঙালি-অবাঙালি বিভেদের আয়নায় পড়তে পারে একমাত্র সেই রাষ্ট্রশক্তিই যে ‘শত্রু মিত্র সকলের প্রতি সংশয়-কণ্টকিত’, এবং শিক্ষিত চিন্তাশীল সংস্কৃতিমনস্ক সমাজের সমস্ত সতর্কবাণীকে হেলায় উপেক্ষা করে সীমাহীন স্পর্ধায় যে নিজের ক্ষমতাধ্বজা জাহির করতে পারে।
কোন রচনা কে কী ভাবে পড়বেন, তা নিয়ে জবরদস্তি চলে না। সরকারি কর্তারা গানটির মধ্যে ওই বাণী বা ভাবটি না দেখতেই পারেন। কিন্তু তাঁদের কার্যসিদ্ধির জন্য রবীন্দ্র-গানের শব্দে ইচ্ছামতো কারিকুরি করে নিয়ে তাকে ‘রাজ্যসঙ্গীত’ করা চলে না। দরকার বোধ করলে নিজেরাই অন্য গান লিখে নেওয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদবর্গ কি আদৌ বুঝতে পারছেন, এই যথেচ্ছাচারের ফলে কী অসম্ভব বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল? অতঃপর জাতীয় সঙ্গীতে এমন কারিকুরি হলে আপত্তি তোলার মুখ তাঁদের থাকবে কি? রবীন্দ্রনাথের দোহাই, যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে, এর পর থেকে গানটি যেন তার নিজ শব্দে, নিজ সুরে গীত হয়। এই গান কোনও সরকার বা দলের সম্পত্তি নয়, বাংলা ও বাঙালির অমূল্য উত্তরাধিকার।