—প্রতীকী চিত্র।
সমাধান যে কখনও কখনও সমস্যার থেকেও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশিকা তার দৃষ্টান্ত। নির্দেশিকাটি বইপত্র বা প্রবন্ধের মতো পাঠ্যবস্তুর অনুবাদ সংক্রান্ত। এই বিষয়ে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক গবেষকদের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ইউজিসি নির্দেশিকাটি জারি করেছে। অনুবাদ নিয়ে বাস্তবিকই অনেক সমস্যা। এক দিকে আড়ষ্ট বা অসুন্দর অনুবাদ এবং অন্য দিকে অ-বিশ্বস্ত অনুবাদ তো চিরকালের সমস্যা, তার উপরে আছে সরাসরি ভুল অনুবাদের ব্যাধি, অধুনা বাংলা ভাষার বিভিন্ন পরিসরে যার রকমারি উৎকট নমুনা অতিমাত্রায় সুলভ। অথচ অনুবাদ না হলে বহু কাজই চলে না। বিশেষত আজকের বিশ্বায়িত এবং তাৎক্ষণিক সভ্যতায় বিভিন্ন ভাষার লেনদেন অভূতপূর্ব মাত্রায় বেড়ে চলেছে, সুতরাং বহু ক্ষেত্রেই অনুবাদ সম্পূর্ণত অপরিহার্য। বিশেষত উচ্চশিক্ষার পরিসরে। এক দিকে দুনিয়া জুড়ে ইংরেজি-সহ বিভিন্ন ভাষায় জ্ঞান ও তথ্যের সম্ভার বিদ্যুৎগতিতে প্রসারিত হচ্ছে, অন্য দিকে ভারতের মতো দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের স্বভাষায় সেই সম্ভারকে সহজবোধ্য করে তোলার চাহিদাও বাড়ছে। এত অনুবাদ কে করবে, কী ভাবে করে উঠবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ইউজিসি-র সহজ নিদান: এআই, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম যন্ত্রমেধা। এআই প্রযুক্তির সাহায্যে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করে পাঠ্যবস্তুর পরিধি ও বোধগম্যতা বাড়ানোর এক বিশদ প্রস্তাব দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যে প্রস্তাব কার্যকর করা যাবে। পুরনো সমস্যার নতুন সমাধান।
এমন সমাধান নিয়ে দু’টি প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, যন্ত্রমেধার প্রয়োগে যে সব অনুবাদ চলছে, তা অনেক সময়েই নিম্নমানের, প্রায়শই ভুলে ভরা, যা অনায়াসে শিক্ষার বদলে অশিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারে। এই বিপদ সামলাতে ইউজিসি তাদের নির্দেশিকায় যন্ত্রমেধার হাতে প্রাথমিক অনুবাদের দায়িত্ব দিতে চেয়েছে, সেই অনুবাদের বিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষ যাচাই করবেন ছাত্রছাত্রী শিক্ষক গবেষকরা। এবং, বিশেষজ্ঞরা আশ্বাস দিয়েছেন, এই ধরনের পরিমার্জনের মধ্য দিয়েই যন্ত্রমেধা ক্রমশ তার কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে তুলবে, আরও দ্রুত আরও বেশি নির্ভরযোগ্য অনুবাদ মিলবে, সুতরাং মানুষের সংশোধনী দায়িত্ব সেই অনুপাতে কমবে। ঠিক সেখানেই উঠে আসে দ্বিতীয় প্রশ্নটি। অনুবাদের দায় থেকে মানুষ যদি ক্রমশ মুক্তি পায়, তবে অনুবাদের সামর্থ্যও সে উত্তরোত্তর হারিয়ে ফেলবে। বিদ্যাচর্চার অন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মতোই অনুবাদ মানুষের মেধা ও বুদ্ধির একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুশীলন। সেই অনুশীলন কেবল শব্দ ও বাক্যের অর্থ সন্ধানে সীমিত থাকে না, সংশ্লিষ্ট বিষয় ও ভাষা নিয়ে নতুন চিন্তার পথ খুলে দেয়। অনুবাদের ফল কী হল, তার পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— অনুবাদকের ভাবনা ও বোধের স্তরে কী পরিবর্তন সাধিত হল। যন্ত্রের হাতে এই কাজ যত সমর্পিত হবে, বোধ বুদ্ধি চিন্তা মেধার ততই ক্ষয় হতে বাধ্য। যন্ত্রের দক্ষতা বহু ক্ষেত্রে বহু কাল ধরেই মানুষের বিবিধ দক্ষতা হরণ করেছে, সচরাচর তাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ করে তোলার পথেই হরণ করেছে। যন্ত্রগণক এসে বহু মানুষের গণনা-শক্তি, এমনকি ছোট ছোট যোগ-বিয়োগ করার সামর্থ্য তথা আত্মবিশ্বাস কী ভাবে হরণ করেছে, তার অগণন নমুনা সর্বজনপরিচিত। সেই পুরনো প্রক্রিয়ার এক নতুন পর্ব শুরু হয়েছে যন্ত্রমেধার এই নবযুগে।
সব দক্ষতা বা সামর্থ্য নিশ্চয়ই সমান মূল্যবান নয়। অনেক কাজ লাঘব হলেই মানুষের জীবনে উন্নতির সুযোগ আসে। কিন্তু চিন্তাভাবনা এবং অনুশীলনের কাজও যদি যন্ত্র সাধন করে দেয়, তা হলে জ্ঞানচর্চার কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে? বলা বাহুল্য, এই প্রশ্ন কেবল অনুবাদের বিষয়ে নয়, পঠনপাঠনের সমস্ত ক্ষেত্রে এখন এআই প্রবেশ করেছে, করছে অথবা করবে। শিক্ষা প্রসারের নামে দ্রুত নানা ভাষায় সব কিছু অনুবাদ করে ফেলার পথ খুঁজতে গিয়ে ইউজিসি শিক্ষার শিকড়টিই কেটে ফেলার ব্যবস্থা করছে না তো? এই পথে চলতে চলতে অচিরেই হয়তো দেখা যাবে, অনুবাদ থেকে গবেষণাপত্র লেখা, প্রশ্নপত্র নির্মাণ থেকে উত্তরপত্র উৎপাদন, সকলের সব কাজই যন্ত্রমেধা নিমেষে সেরে ফেলছে, অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আবিষ্কার করছেন তাঁদের সব কাজ উধাও, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে শিক্ষানায়করা পরম আহ্লাদে ঘোষণা করছেন: আর পাঠশালা নাই।