Primary Teacher Recruitment

‘যাহা উদ্ভট’

চাকরির পরীক্ষার সঙ্গে চাকরি পাওয়ার যদি সম্পর্ক না থাকে, তা হলে সেই পরীক্ষাটির উপযোগিতা কী, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সমীপে এমন প্রশ্ন পেশ করে বিশেষ লাভ হবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৫৪
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’, আবোল তাবোল-এ নেড়ার বেলতলা যাত্রা নিয়ে ভাবিত রাজার এই অবস্থাটির বর্ণনা দিয়েছিলেন সুকুমার রায়। কেন, তার ব্যাখ্যা মিলল এই মহাগ্রন্থ প্রকাশের শতবর্ষ অতিক্রান্ত হওয়ার সময়। পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি জানিয়েছেন, খাওয়া এবং গেলা— অর্থাৎ টেট পরীক্ষা গ্রহণ এবং সফল পরীক্ষার্থীদের চাকরি দেওয়া— দুটো সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়া। ফলে গত ডিসেম্বরে ছয় লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীর মধ্যে যে দেড় লক্ষ সফল হয়েছিলেন, তাঁদের এক জনেরও চাকরির ব্যবস্থা হয়নি বটে, কিন্তু এই ডিসেম্বরে টেট পরীক্ষার দিন ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। চাকরির পরীক্ষার সঙ্গে চাকরি পাওয়ার যদি সম্পর্ক না থাকে, তা হলে সেই পরীক্ষাটির উপযোগিতা কী, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ সমীপে এমন প্রশ্ন পেশ করে বিশেষ লাভ হবে না। পর্ষদ জানিয়েছে, ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন-এর গাইডলাইন, এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুসারে প্রতি বছর টেট পরীক্ষার আয়োজন করতেই হবে; অন্য দিকে, বিগত পরীক্ষাগুলির সফল প্রার্থীদের নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আটকে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া মামলার কারণে। অনুমান করা চলে, রাজ্য সরকারের প্রত্যাশা যে, এ রাজ্যের টেট পরীক্ষার্থীরা ভগবদ্‌গীতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হবেন। তাঁরা ফলের আশা ব্যতিরেকেই চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যাবেন, এবং ক্ষোভ চরমে উঠলে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে অবস্থান বিক্ষোভ প্রদর্শন করবেন।

Advertisement

দূর থেকে দেখলে মনে হবে, এ বুঝি কোনও কাফকা-কাহিনির মঞ্চাভিনয় চলছে, যেখানে দেওয়াল থেকে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরাই চরিত্রটির ভবিতব্য। কিন্তু আবোল তাবোল পড়া বাঙালি জানে, ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই’ এই রাজ্যের কারবার। কত দিন অন্তর চাকরির পরীক্ষা হবে, সফল পরীক্ষার্থীদের নিয়োগ করা হবে কবে, এই সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করার কথা রাজ্য সরকারের, অথবা সরকারের অধীনে থাকা পর্ষদগুলির। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে প্রশাসনের প্রাথমিক কর্তব্য, এই কথাটি আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। কিন্তু পড়ে, তার কারণ, যত দিন কাটছে, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটি তত বেশি করে আদালত-নির্ভর হয়ে উঠছে। যে কাজ শাসনবিভাগের, তা সম্পূর্ণত বিচারবিভাগের দায়িত্বে পরিণত হচ্ছে। ঘটনা হল, এই প্রবণতাকে আদালতের অতিসক্রিয়তা বলে দেগে দেওয়া মুশকিল। রাজ্যের কার্যত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই নিষ্পত্তি হচ্ছে আদালতে, কারণ কার্যত প্রতি ক্ষেত্রেই সরকার ও প্রশাসন অযোগ্যতা, অদক্ষতা এবং নিরপেক্ষতার অভাবের অকাট্য প্রমাণ পেশ করেছে। ফলে, সরকারের যে কোনও সিদ্ধান্তই আদালতে গড়াচ্ছে, এবং কার্যত আদালতের নির্দেশেই রাজ্য পরিচালিত হচ্ছে। গণতন্ত্রে এই পরিস্থিতি মারাত্মক। কিন্তু, রাজ্য সরকার বিকল্প কোনও পথ অবশিষ্ট রাখেনি।

শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নে এই রাজ্যে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে, কোনও নিন্দাই তার পক্ষে যথেষ্ট নয়। শাসক দলের ‘খাজনা’ আদায়ের প্রবণতার কাছে প্রশাসন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করায় যা ঘটেছে, তা যে কোনও রাজ্যের পক্ষে গভীর লজ্জার কারণ। অন্য দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের প্রশ্নেও বিগত কয়েক বছর যে ঘোর অনিয়ম হয়েছে, তার ফলে শেষ অবধি রাজ্য সরকারকে বলতে হচ্ছে যে, আদালত সার্চ কমিটি গড়ে দিলে রাজ্যের তাতে আপত্তি নেই। মূল সমস্যা হল, রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনকে যদি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা হয়, যদি ব্যক্তিবিশেষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই হয়ে দাঁড়ায় শেষ কথা, তবে তার এই পরিণতি হওয়া কার্যত অবশ্যম্ভাবী। পশ্চিমবঙ্গকে এই পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার দায় রাজ্য সরকার এবং রাজ্যের শাসক দলকে স্বীকার করতেই হবে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের কথা, এই অতলে পৌঁছেও হুঁশ ফিরবে, তেমন নিশ্চয়তা নেই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement