প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি পদক্ষেপই তাঁর দেশের সংবাদমাধ্যম সহর্ষে সরবে প্রচার করে থাকে, তাঁর সাম্প্রতিক আমেরিকা সফর নিয়ে দেশময় হইচই পড়বে এ নিয়ে সংশয় ছিল না। তবু প্রধানমন্ত্রী মোদীর এ বারের অতলান্তিকপারের সাফল্যগাথা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হওয়ার মাত্রাটি বিশেষ লক্ষণীয়। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, এ বার নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকা সফর যত সফল, আগে কোনও নেতার আমলেই এমনটা ঘটেনি। বোঝা যায়, এই সফর কেবল কূটনৈতিক ভাবে সফল হওয়াই জরুরি ছিল না, রাজনৈতিক ভাবেও প্রধানমন্ত্রীর নিজের জন্য, এবং তাঁর দলের জন্য অতীব গুরুতর ছিল। একই সঙ্গে, বিরোধীরাও যে ফলফুল ছেড়ে কাঁটার দিকেই বেশি মনোযোগ দেবেন, কী হল-র থেকে কী হল না, কী হওয়ার কথাই ছিল না, তা নিয়েই চর্চা করবেন— সেও অভাবিত নয়। এর মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে সফরের সত্যিকারের পাওয়া না-পাওয়ার হিসাবটি।
দুই দিকের এই সামূহিক প্রচার-জালিকা থেকে আলাদা করে মোদীর আমেরিকা সফরকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখলে প্রথমেই নজরে আসে: এক, তিনি যে ভাবে দুই-দুই বার আমেরিকান কংগ্রেসে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেলেন, খুব কম বিদেশি নেতাই তা পেয়েছেন। এর আগে এমন সুযোগ পেয়েছেন দুই জন মাত্র: উইনস্টন চার্চিল ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। দুই, বহু বাধাবিপত্তি, চ্যালেঞ্জ-সঙ্কট সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক আমেরিকা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখে, তা স্পষ্ট হল এই সফরে। এক হোয়াইট হাউস-কর্তার ভাষায়, আমেরিকার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভারতের সঙ্গেই। তৃতীয়ত, সাত বছর আগে মোদীর আগের সফরের সময় থেকে আমেরিকার কূটনীতিবিশ্বে ভারতের প্রয়োজন যতটা বেড়েছে, এবং পাকিস্তান ও চিন সঙ্কট যতটা বেড়েছে— তার মধ্যে কেবল সম-অনুপাত নেই, প্রায় মাপে মাপে সমতা আছে। বাণিজ্যের দিক থেকেও ভারতের সবচেয়ে বড় মিত্র এখন আমেরিকা। সুতরাং দুই তরফেই অনেক প্রতিশ্রুতি শোনা গেল: বাণিজ্য-ক্ষেত্রে, নিরাপত্তা-ক্ষেত্রে। পরিবেশ-ক্ষেত্রেও।
নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ আর একটি কথাও বলে। এই সাফল্য যতটা না প্রধানমন্ত্রী মোদীর, তার থেকে অনেক বেশি ভারতের, এখনও যার পরিচয় গণতান্ত্রিক, স্বাধীনতাকামী, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবেই। মোদী ও তাঁর ভক্তবৃন্দরা যতই ব্যক্তিপ্রচারের ঢক্কানিনাদের মোড়কে সেই রাষ্ট্রীয় গৌরবকে পরিবেশন করার চেষ্টা করুন না কেন, তাতে সত্যের ভাগটি কমে যায় না। বরং, স্মরণ করে নেওয়া ভাল যে আমেরিকার হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস বা ‘কংগ্রেস’-এর অন্তত সত্তর জন জননির্বাচিত প্রতিনিধি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে লিখিত আর্জি জানিয়েছিলেন, গণতান্ত্রিক ভারত যে নেতার অধীনে দ্রুত তার গণতান্ত্রিক অধিকারের তালিকাটি ছেঁটে ফেলতে বসেছে, তাঁকে আমেরিকায় এমন রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা না দেওয়া হোক। অন্তত চার জন ‘কংগ্রেস’-প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তৃতা বয়কট করেছিলেন, যে বক্তৃতায় তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আজকের ভারত কতটা মুক্ত ও গণতান্ত্রিক, সেই উদাত্ত বার্তা দিচ্ছিলেন। প্রধান প্রচারমাধ্যমগুলি প্রধানমন্ত্রী মোদীর অসত্যভাষণ এবং ভারতের সাম্প্রতিক নাগরিক অধিকার নিষ্পেষণের তালিকা প্রকাশ করে গিয়েছে, যত দিন মোদী আমেরিকার অতিথি ছিলেন, তার প্রতিটি দিন জুড়েই। মোদীভক্তকুল অবশ্যই স্বীকার করবেন না, কিন্তু ভারত-আমেরিকার মধ্যে সফররত প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এমন লাগাতার নিন্দাবর্ষণের ঘটনাও কিন্তু অভূতপূর্ব। সে দিক থেকে এই সফর একটি অন্য কারণে উল্লেখযোগ্য হয়ে রইল। অন্যান্য দেশে যেমন মোদীর সফর কালে মোদী-বন্দনাই দেখা যায়, আমেরিকা কিন্তু মোদীকে ছাপিয়ে, কিংবা বলা ভাল, মোদীর উপস্থিতি সত্ত্বেও, ভারতেরই বন্দনা করল। এই বন্দনা রাষ্ট্রের অর্জন, দেশের গৌরব। কোনও একক ব্যক্তির নিজস্ব শিরোভূষণ নয়।