PM Narendra Modi

যদা যদা হি ভোটস্য

ধর্মাচরণের দিনক্ষণ তাঁর নির্ঘণ্ট অনুসারেই স্থির করা হয়েছে কি না, এমন অনুমানের জন্য কোনও পুরস্কার নেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৫০
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

ধর্মাচরণের প্রশস্ত স্থান কোথায়? প্রকৃত ধার্মিক বলবেন: মনে, বনে, আর কোণে। কিন্তু ধর্ম যদি রাজনীতির হাতিয়ার হয়, ধর্মীয় আচার হয়ে দাঁড়ায় ভোট বাড়ানোর কৌশল, তখন ধর্মাচরণের জন্য ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড ভাড়া করা ছাড়া উপায় কী? সুতরাং ২৪ ডিসেম্বর, শীতের কলকাতায়, ব্রিগেডের ময়দানে লক্ষকণ্ঠে গীতাপাঠের আয়োজন হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর ভারততীর্থে এমনই হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর নামটি অকারণ উঠল না, ‘কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের’ উদ্যোগে এই সভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, কিন্তু সেই আমন্ত্রণ নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন রাজ্য বিজেপির কর্তাব্যক্তিরা। কার্যকারণসূত্রটি সহজবোধ্য। ধর্মাচরণের দিনক্ষণ তাঁর নির্ঘণ্ট অনুসারেই স্থির করা হয়েছে কি না, এমন অনুমানের জন্য কোনও পুরস্কার নেই। ময়দানি গীতাপাঠের আসরে তাঁর এই উপস্থিতিতে স্বয়ং পার্থসারথি আপন ভুবনে বসে ধন্য বোধ করবেন কি না, সে কথা অবশ্য তাঁদের ভক্তরাই বলতে পারবেন।

Advertisement

অনিচ্ছুক অর্জুনকে যুদ্ধে নামানোর তাগিদে কৃষ্ণের প্রলম্বিত বক্তৃতা (এবং বিশ্বরূপ দর্শনের অলৌকিক লীলা) বিষয়ে বহুকাল যাবৎ কথাসরিৎসাগর রচিত হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন এবং অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু গড়ের মাঠে লক্ষ মানুষ ডেকে গীতাপাঠের অভিনব আয়োজন এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সাড়ম্বর উপস্থিতির পরিকল্পনা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নির্বাচনী তৎপরতার উগ্র এবং অনৈতিক রূপটিকে এক নতুন মাত্রা দিতে চলেছে, এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বলা দরকার। জানুয়ারির শেষে রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে যে প্রকল্প রচিত হয়েছে, ব্রিগেডের এই আয়োজন স্পষ্টতই তার অঙ্গ। লোকসভা নির্বাচনের প্রচার অভিযানে উন্নয়ন বা সমাজকল্যাণের সুস্থ স্বাভাবিক প্রসঙ্গগুলিকে শিকেয় তুলে হিন্দুত্বের রাজনৈতিক মূর্তিটিকে অতিকায় চেহারা দেওয়া এবং সেই অবয়বের ধর্মমোহে মানুষের চিন্তা ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করে আপন শিবিরে ‘সংখ্যাগুরু’ ভোট সংহত করার পরিচিত ছকটিই এই উদ্যোগকে চালনা করছে। ত্রেতার রামচন্দ্রের মতোই দ্বাপরের গীতাকেও ব্যবহার করা হচ্ছে ঘোর কলির ভোটযুদ্ধে। তার সঙ্গে প্রকৃত ধর্ম বা ধার্মিকতার কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই।

এ দেশে যথার্থ গণতন্ত্রকে যদি বাঁচতে হয়, তবে এই বিপজ্জনক ধর্মমোহের প্রতিস্পর্ধী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রকল্প কেবল প্রয়োজনীয় নয়, অপরিহার্য। তার জন্য গীতাপাঠের বিরোধিতার প্রয়োজন নেই, ধর্ম এবং ধার্মিকতার বিরোধিতায় সরব হওয়ারও কোনও যৌক্তিকতা নেই, বরং সেই পথে হাঁটলে বহু সুস্থবুদ্ধির মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এই বিপদের মোকাবিলায় জরুরি হল রাজনীতিকে, বিশেষত বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের যথার্থ প্রয়োজনের পরিসরে নিয়ে আসা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সাম্যের প্রসারে কী করণীয়, রাজনীতিকদের সেই বিষয়ে আলোচনায় বাধ্য করা। শাসকরা ক্রমাগত সেই আলোচনা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে তাঁদের মন্দিরে, আরতিতে, যাগযজ্ঞে এবং গীতাপাঠে ভোলাতে চাইছেন। এই কৌশল সফল হলে কেবল ‘সংখ্যাগুরু’কে সংহত করা সহজ হয় না, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজেদের সমস্ত অপদার্থতাকেও আড়াল করা যায়। এই অভিসন্ধিকে সমূলে প্রতিহত করা ছাড়া কোনও পথ নেই। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদরা যত খুশি গীতা পড়তে চান, পড়ুন, কিন্তু মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্য সুপরিবেশ নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রকৃত প্রয়োজন মেটানোর কী হবে, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁদের দাঁড় করানোই গণতান্ত্রিক রাজনীতির একমাত্র কাজ। ভারতীয় রাজনীতিকে সঙ্ঘ পরিবারের অবান্তর নামাবলি থেকে মুক্ত করে প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে চালিত করা যাবে কি না, সেটাই এখন প্রকৃত প্রশ্ন। গীতার আঠারো অধ্যায়ে তার উত্তর নেই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement