Gandhi Jayanti 2023

স্বচ্ছতার নেপথ্যে

এই বছর ১ অক্টোবর রবিবার, গান্ধীকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘স্বচ্ছতাই সেবা’ অভিযানের সূচনা ঘটালেন নিজে সম্মার্জনী হাতে এগিয়ে এসে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:২১
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

বছরের সেই সময়টি উপস্থিত, যখন নেতাদের রাজপথে ঝাড়ু হাতে দেখতে পাওয়া একটি রীতিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকরা মনে করেন যে, মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার এ এক প্রকৃষ্ট উপায়। এই বছর এক দিন আগেই, গত কাল রবিবার, গান্ধীকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘স্বচ্ছতাই সেবা’ অভিযানের সূচনা ঘটালেন নিজে সম্মার্জনী হাতে এগিয়ে এসে। সমাজমাধ্যমে ভিডিয়ো-বার্তাও প্রচারিত হল, পরিবেশ-স্বচ্ছতা ও স্বাস্থ্য-সচেতনতার সংযোগ যে কত অবশ্যপালনীয় আদর্শ, সমগ্র দেশকে মনে করিয়ে দেওয়া হল। বার্তাটি জরুরি। কিন্তু গান্ধী জয়ন্তীর দিনটিকে এই বার্তা প্রচারের জন্য বেছে নেওয়ার মধ্যে আরও কিছু প্রচ্ছন্ন কথা থাকে, যা খেয়াল না করলেই নয়। প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে যেহেতু ভারতের এখনও গান্ধীর চেয়ে বড় কোনও ‘আইকন’ নেই, জি২০-র নেতারা দিল্লিতে এলেও রাজঘাটে এক বিশেষ শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের আয়োজন হল। সব মিলিয়ে পরিষ্কার, বর্তমান সরকার বোঝাতে চায় তাদের রাজনীতি আসলে গান্ধীর আদর্শেই স্থিত।

Advertisement

এবং এই লক্ষ্যেই গান্ধীকে এই ভাবে কিছু প্রতীকে পর্যবসিত করার প্রয়াস, তাঁর জন্মদিনের সঙ্গে স্বচ্ছতা অভিযানকে এমন ভাবে জড়িয়ে ফেলার প্রচেষ্টা। এক বিশেষ রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির নেতাদের বার বার এমন কাজ করতে হয়। সঙ্কট— কেননা মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী নিজে আদ্যন্ত হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু মহাসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাঁকে শত্রুভাবে না দেখে পারেনি। হিন্দু সমাজের বিপক্ষ হিসাবে তাঁকে কতটাই অগ্রহণযোগ্য নিরূপণ করা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী মানসে, তা গডসে-কৃত নিধনকাণ্ডেই স্পষ্ট। এ দিকে, নেহরুকে যেমন শত্রু হিসাবে নিজেদের রাজনীতির উল্টো দিকে দাঁড় করানো যায়, গান্ধীর ক্ষেত্রে তা করা বিপজ্জনক। ভারতীয় জাতীয় জীবনের সঙ্গে তাঁর নাম ও ভাবনা জড়ানো অবিচ্ছেদ্য ভাবে। তাই তাঁর রাজনীতি থেকে তাঁকে বিযুক্ত করে আত্মসাৎ করতে হচ্ছে— তাঁর চশমা, লাঠি, চরকা ইত্যাদিকে নিতে হচ্ছে প্রচারের মাধ্যম হিসাবে। স্বচ্ছতার উপর ভর দেওয়াও সেই প্রচারের অঙ্গ হিসাবে দেখা যায়। মনে রাখা যেতে পারে যে, গান্ধী ঘোষিত ভাবেই বর্ণাশ্রমের সমর্থক ছিলেন, জন্মসূত্রে জীবিকা নির্ধারণেরও বিরোধী ছিলেন না। বর্ণাশ্রমের প্রশ্নে গান্ধীর অবস্থান নিয়ে বিস্তর তর্ক হয়েছে, সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু, তাতে এই সত্যটি ঢাকা পড়ে না যে, এই প্রশ্নেও গান্ধীর অবস্থান হিন্দুত্ববাদীদের থেকে প্রকট ভাবে আলাদা। হিন্দুত্ববাদীরা এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ভেবেছেন অশুচি; আর গান্ধী সামাজিক উচ্চাবচতাকে মেনে নিয়েও বারংবার তাঁর ‘হরিজন’দের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের জীবনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন গঠনমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে। তিনি বর্ণাশ্রমের কাঠামোর বিরুদ্ধতা করেননি বটে, কিন্তু সেই কাঠামোর অন্তর্নিহিত নিষ্ঠুরতাকে চিহ্নিত করেছেন, নিরলস চেষ্টা করেছেন তার উপশমের।

তাই এমনকি ‘স্বচ্ছতা’ নীতির আয়নায় দেখলেও, হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে গান্ধীর পার্থক্য এই সহমর্মিতার রাজনীতিতেই। গত দশ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে— মূলত উত্তর ও পশ্চিম ভারতে— তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের উপরে ঘৃণা-অপরাধের প্রবণতা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে। যারা অপরাধী, তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতি আনুগত্য গোপন করার চেষ্টাও করেনি। তাদের অপরাধের নিন্দাও করেননি শাসকরা। সুতরাং, গান্ধী জয়ন্তী উপলক্ষে যে নেতারা আজ রাস্তা পরিষ্কার করছেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহমর্মিতার প্রমাণ দিয়ে তাঁরা অত্যাচারিত গোষ্ঠীর পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন, এ প্রত্যাশা আর নেই। গান্ধীকে তাঁরা আত্মসাৎ করেন হয়তো এই কথা জেনেই যে গান্ধীর পথে চলার আত্মিক সামর্থ্য তাঁদের নেই, কোনও দিন ছিল না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement