—প্রতীকী ছবি।
দেশভাগের স্মৃতি বিষয়ে গত কয়েক দশকে অনেক আলোচনা ও গবেষণা হয়ে গিয়েছে। সেই স্মৃতি মনে রাখা কত যে গুরুত্বপূর্ণ আজকের বর্তমানে, তা নিয়েও কথা কম হয়নি। আবার, একই সঙ্গে দেশভাগের স্মৃতি ভুল ভাবে উস্কে দেওয়ার বিপদ যে অত্যন্ত গভীর— তাও কি কম বলা হয়েছে ইতিমধ্যে? অথচ দেখা যাচ্ছে, গত কিছু বছর ধরে লাগাতার যে ভাবে দেশভাগের স্মৃতি জনপরিসরে নিয়ে আসা হচ্ছে, তার বেশির ভাগটারই পিছনে একটি সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে— বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আছে যে, মুসলমানদের জন্যই উপমহাদেশের অগণিত নারীপুরুষকে দেশভাগের বীভৎসতা দেখতে হয়েছিল, তাই আজ রাজনৈতিক কার্যক্রম ছকতে হবে সেই স্মৃতি রোমন্থন করে করে। গত বছর থেকে ১৪ অগস্টকে ‘দেশভাগ স্মৃতি দিবস’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সে দিক দিয়ে দেখলে এটি সেই ‘পার্টিশন রিমেমব্রান্স ডে’-র দ্বিতীয় বছর। সেই দ্বিতীয় বছরে, স্বাধীনতা ও দেশভাগের ছিয়াত্তর বছর পূর্তির আগটিতে— দেশের প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো কয়েকটি ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’-এর ছবি প্রকাশ করল। দেখতে গিয়ে একটা নাছোড় প্রশ্ন নাগরিকের মনে জাগতে পারে। স্মরণের এই মালা গাঁথার পিছনের ভাবনাটি ঠিক কী? দেশের মানুষকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে একত্র জীবনযাপনের সহিষ্ণুতা ও সংযম শেখানো? না কি পুরনো সংঘাতের কাহিনি উস্কে দিয়ে মানুষকে পুরনো উত্তেজনার আঁচে জ্বলতে সাহায্য করা?
সরকারি প্রবক্তারা বলতে পারেন, এত কথা উঠছে কেন, দেশভাগ তো বাস্তব ঘটনা, সেই বাস্তবেরই তো ছবি দেখানো হচ্ছে! এর বিপরীতে প্রশ্ন করতে হয়, দেশভাগের ফলে দুই ধর্মসম্প্রদায়েরই যে বিরাট সঙ্কট হয়েছিল সে দিন— ইতিহাস স্মরণ করার সময়ে সঙ্কটের সেই সামগ্রিকতাকে ধরার চেষ্টা হচ্ছে তো? না কি ইতিমধ্যে বার বার দেশের কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপির প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতারাই প্রকাশ্যে, সরবে, প্রবল ভাবে এবং অতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজকে দেশভাগ নামক বিশাল মানবিক ট্র্যাজেডির জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন, তারই একটি চিত্রভাষ্য তৈরি হচ্ছে। সিঁদুরে মেঘ দেখলে গরু ত্রাসে শিউরে উঠলে দোষ দেওয়া যায় কি?
এমতাবস্থায় কী করণীয়? দেশভাগের স্মৃতি জাগরূক রাখা দরকার, সন্দেহ নেই। পরবর্তী প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি, কত রক্তক্ষয় ও সর্বনাশের দামে এই দেশ তার স্বাধীনতা কিনতে পেরেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে। কিন্তু যখন সেই দেশভাগের স্মৃতি মনে করানো হচ্ছে, তখন কেবল কোনও একটি বিশেষ পক্ষের উপর অন্য পক্ষের অত্যাচার দেখালে সেই রাজনীতি বিষবৎ পরিত্যাজ্য। অর্থাৎ, বয়ান কিংবা ব্যাখ্যাটি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশভাগের স্মৃতি জাগিয়ে রাখার প্রথম, প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত— সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিদ্বেষের রাজনীতি যে সাধারণ নিরীহ জনসাধারণকে কত ভয়ঙ্কর অমানবিকতায় নিক্ষেপ করতে পারে, সেটাই মনে করানো। আবার নতুন করে কোনও বিদ্বেষ এবং তার থেকে ভয়ানক সংঘাতের দিকে মানুষকে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তা করা কেবল বিপজ্জনক নয়, রাজনৈতিক বর্বরতা। এই প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক তথ্য স্মরণ করানোও জরুরি, মুসলমানরা পাকিস্তান চেয়েছিলেন, কিন্তু এহেন দেশভাগ চেয়েছিলেন, এই তথ্যের বিপরীত তথ্য অনেক। ইতিহাস বলবে, বহু মুসলমান রাজনীতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আগ্রহী ছিলেন। দেশভাগের জন্য হিন্দুরাও সমধিক দায়ী। এবং এই প্রসঙ্গে একটি শেষ দাবি: দেশভাগ এড়ানোর কোনও পথই যে সে দিন পাওয়া যায়নি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তার প্রথম দায় নিতে হবে— ইতিহাসের তথ্য তা-ই বলে। সুতরাং তথ্যের ইতিহাসে ফেরা দরকার, ইতিহাসের রাজনীতিতে নয়।