ফাইল চিত্র।
বিপদের সম্মুখে নিরুদ্বিগ্ন থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। কিন্তু নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে সেই বিপদকে ডাকিয়া আনা এবং অন্যদেরও বিপন্ন করিয়া তুলিবার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নাই। ইহা সবিশেষ নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সম্প্রতি সেই পরিচয়ই দিতেছেন। তাঁহাদের আচরণ দেখিয়া বোধ হইতেছে, করোনাভাইরাস বুঝি এই রাজ্য ছাড়িয়া পিটটান দিয়াছে। হাসপাতালগুলিতে আর এক জনও রোগী নাই, নূতন করিয়া আর কেহই আক্রান্ত হইতেছেন না। সুতরাং, তাঁহারা অকুতোভয় চিত্তে মাস্ক খুলিয়া ফেলিয়াছেন, সামাজিক দূরত্ববিধি অগ্রাহ্য করিতেছেন। গণপরিবহণ, বাজারে উপচাইয়া পড়া ভিড়, মেলার মাঠ, সপ্তাহান্তের আমোদ— সমস্ত যথাপূর্বং। তদুপরি, ইহা বসন্তকাল। সদ্য সরস্বতী পূজা এবং প্রেমদিবস সমাপ্ত হইয়াছে। সপ্তাহভর চোখে পড়িয়াছে ‘মজা করিবার’ তুমুল তাড়না। দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই, কোভিড-১৯ আদৌ এই রাজ্যে পা রাখিয়াছিল কি না।
বৈশ্বিক প্রবণতা লক্ষ করিলে বুঝা যাইবে, এহেন অপরিণামদর্শিতার ফল কী ভয়াবহ হইতে পারে। ইউরোপ, আমেরিকার ন্যায় শক্তপোক্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোযুক্ত দেশও স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছে, পরিস্থিতি ফের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। সেই দেশগুলিতেও কিন্তু এক সময় সংক্রমণ তলানিতে ঠেকিয়াছিল। নিয়মপালনে সামান্য শিথিলতার চরম মাসুল দিতে সময় লাগে নাই। এবং প্রমাণিত হইয়াছে, এই দ্বিতীয়, কোথাও তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা পূর্বের তুলনায় বহুগুণ তীব্র। বিশেষত, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি গত বৎসর সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে সফল ভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণ করিয়া প্রশংসা কুড়াইয়াছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাহারা একের পর এক ধরাশায়ী। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করিতে লকডাউন ফিরাইয়া আনিতে হইয়াছে। অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। আমেরিকায় থ্যাঙ্কসগিভিং ডে-র হুল্লোড় এবং তৎপরবর্তী করোনা সংক্রমণে সুনামির কথা কি এই রাজ্যের মানুষ এত দ্রুত ভুলিয়া গেল? ভারতের পরিস্থিতিও অত্যন্ত উদ্বেগের। কেরল, মহারাষ্ট্রে পুনরায় নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে বৃদ্ধি পাইতেছে রোগীর সংখ্যা। মহারাষ্ট্রের একাধিক জেলায় ইতিমধ্যেই লকডাউন শুরু হইয়াছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিয়াছেন, দুই সপ্তাহে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসিলে রাজ্য জুড়িয়া লকডাউন শুরু হইবে। ইহার পরেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নিয়মবিধি পালন না করিবার ন্যায় ঔদ্ধত্য আসে কোথা হইতে?
নিয়ম না মানিবার সহজাত প্রবণতা এবং ভ্যাকসিনের আগমন সম্ভবত এই চরম দুঃসাহসের কারণ। মনে রাখিতে হইবে, ভ্যাকসিনের আগমন এবং করোনা বিদায়ের পর্বের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব। বিপুল জনসংখ্যার দেশে ভ্যাকসিন সকলের কাছে পৌঁছাইতে বহু সময় লাগিবে। সেই কারণেই নিয়মবিধি মানিয়া চলা আবশ্যক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খুলিতেছে। এমতাবস্থায় শিক্ষা এবং জীবিকা যাহাতে সুরক্ষিত থাকে, তাহা নিশ্চিত করা আপাতত প্রাথমিক কর্তব্য। ভারতীয়দের সৌভাগ্য, জিন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বা অন্য কোনও অজ্ঞাত কারণে বিদেশের তুলনায় তাঁহাদের অবস্থা কিছু পরিমাণে ভাল। সেই কারণে বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় সংক্রমণের হার কম। কিন্তু সৌভাগ্যকে দুর্ভাগ্যে পরিণত করিবার দায়িত্বটি না লইলেই মঙ্গল।