Constitution Day Of India

পরাজিত স্বপ্ন

অস্বাভাবিক নয়, অপ্রত্যাশিতও বলা চলে না। সংবিধান নিয়ে গৌরবের দিন আপাতত গত-প্রায়। দেশের নেতারা আজকাল ভাবিত থাকেন সংবিধান কী ভাবে সংশোধন বা পরিবর্তন করা চলতে পারে, তা-ই নিয়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:০৮
Share:

২৬ নভেম্বর বহু আগে থেকেই ছিল এ দেশে বিশেষ একটি দিন— সংবিধান দিবস। —ফাইল চিত্র।

তা হলে নভেম্বরও বিগত, এ বারের মতো। মনে পড়তে পারে, কিছু দিন আগে পর্যন্তও, নভেম্বরের শেষ দিকে একটি তারিখ ভারতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত। মুম্বইয়ের তাজ হোটেলের ভয়ানক সন্ত্রাসী হানাই শুধু নয়, ২৬ নভেম্বরটি অন্য এক কারণে তার বহু আগে থেকেই ছিল এ দেশে বিশেষ একটি দিন— সংবিধান দিবস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ কমে আসছিল স্মরণ ও পালনের ঘটা। এ বার দেখা গেল, কিছু বেশিই ছড়িয়েছে সেই নীরবতা। অস্বাভাবিক নয়, অপ্রত্যাশিতও বলা চলে না। সংবিধান নিয়ে গৌরবের দিন আপাতত গত-প্রায়। দেশের নেতারা আজকাল ভাবিত থাকেন সংবিধান কী ভাবে সংশোধন বা পরিবর্তন করা চলতে পারে, তা-ই নিয়ে। কিছু দিন আগেই উপরাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে ব্যগ্রতা প্রকাশ করেছেন, এবং জানিয়েছেন শাসনবিভাগের সম্পূর্ণ এক্তিয়ার আছে এমন পরিবর্তন সাধনের। কিসে কিসে পরিবর্তন আনা হলে বর্তমান শাসকবৃন্দের মনোবাসনা পুরবে, তা-ও নাগরিক সমাজের অজানা নেই। সংবিধানের মুখবন্ধে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দু’টি ঝরতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। এ বার জি২০ সম্মেলনের শুরুর দিন ভারতীয় সংবিধানের যে কপি সকল দেশের প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়া হল, তার মধ্যে স্পষ্টতই এই দুই শব্দের অস্তিত্ব ছিল না। জনৈক কবির পঙ্‌ক্তি মনে পড়তে পারে, ভুবন তবে শেষ হয়— কোনও প্রবল বিস্ফোরণে নয়, ছোট একটি ফুৎকারেই।

Advertisement

এই সামূহিক রাষ্ট্রিক বিস্মরণ এবং উপেক্ষা-অবজ্ঞার মাঝে, হয়তো এক বার দ্রুত স্মরণ করে নেওয়া ভাল কী হয়েছিল ২৬ নভেম্বর। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও তার সংবিধানটি তখনও তৈরি হয়নি। সংবিধান সভা বা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি-র উপর অর্পিত হয়েছিল সেই কাজ, ভীমরাও আম্বেডকরের নেতৃত্বে। সওয়া দুই বছর বাদে, ১৯৪৯ সালের এই দিনটিতে সংবিধান রচনার সমাপ্তি ঘোষণা করে সংবিধান সভা, এবং সংবিধানটিকে গ্রহণ করে। সংবিধান-মতে দেশের শাসনকাজ শুরু হয় আরও দুই মাস পর, ২৬ জানুয়ারি। তাই প্রথম দিনটির নাম হয় সংবিধান দিবস, পরের দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস। এই দুই মাস ধরে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বই-এর পাণ্ডুলিপি যেমন ঘুরেফিরে পঠিত হয়, সেই ভাবেই সংবিধান বার বার পঠিত ও পুনঃপঠিত হচ্ছিল, ইংরেজি থেকে হিন্দিতে অনুবাদের কাজটিও শুরু হয়েছিল। ২৫ নভেম্বর ১৯৪৯, আম্বেডকর নিজে সংবিধান সভায় একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন, যাতে তিনি কিছু উল্লেখযোগ্য কথা বলেন, যার সঙ্গে সংবিধানের যোগটি অতি গভীর। যেমন, সে দিন আম্বেডকর জোর দেন জাতীয় অভিমুখ পরিবর্তনের উপর। বলেন, পরাধীন ভারতের অসহযোগিতা, সত্যাগ্রহের বদলে স্বাধীন ভারত যেন না ভোলে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের গুরুত্ব। বলেন, ভক্তি বস্তুটি ধর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বময় হতে পারে, কিন্তু রাজনীতি থেকে তা শত যোজন দূরে থাকলেই মঙ্গল। দেশীয় সমাজে অসাম্য নিয়ে আম্বেডকরের বিরক্তি সাধারণ ভাবেই আলোচিত। সংবিধান উপস্থাপনার আগের সেই দিনটিতে এই বিরক্তিও তীব্র ভাষায় প্রকাশ করেন তিনি, কেননা অসাম্য দূরীকৃত না হলে, বিরোধিতার পরিসর কমলে তো গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ প্রকল্পটিই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

এ বারের সংবিধান দিবস-পরবর্তী সময়ে সংবিধান-রচয়িতার কথাগুলি আলাদা করে মনে করা যেতে পারে, কেননা প্রতিবাদ ও বিরোধিতার অবনমনে গণতন্ত্রের আব্রুটুকুও আজ আর বজায় থাকছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা কেন, সমালোচনাও এখন দেশদ্রোহ বলে গণ্য হয়, সমাজকর্মী বা সাংবাদিকদের উপর নির্বিচারে দেশদ্রোহ আইনের খাঁড়া নেমে আসে। পরিস্থিতি যা, তাতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যে বর্তমান শাসককে একাধিক বার গণতন্ত্রে বিরোধিতার কেন্দ্রীয় ভূমিকাটি মনে করিয়ে দিয়েছে। সতর্ক করেছে যে, কোনও ধারণা বা কোনও মানুষ সমালোচনা-ঊর্ধ্ব হতে পারে না। তবে এ সব ছাড়াও সংবিধানের ডিরেক্টিভ প্রিন্সিপলস বা মূলগত আদর্শের মধ্যেকার যে কথাটি নষ্ট হতে বসেছে, তা জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কিত। উল্লেখ্য, আম্বেডকরের নিজের ভাবনাচিন্তা, এবং তাঁর প্রণীত সংবিধান, কোনওটিতেই ‘জাতীয়’ বোধটি ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ হিসাবে নির্ণীত হয়নি। তাকে অতিক্রম করে মানবিক সংযোগ, মানবতাবাদী চিন্তাধারার প্রকাশ ও বিকাশের উপর আস্থা ন্যস্ত হয়েছিল। আজকের ভারতে সেই আদর্শটিই হারিয়েছে। সব মিলিয়েই আজ ভারতীয় সাংবিধানিক অস্তিত্ব তুমুল পরাজিত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement