ছবি সংগৃহীত
সময় অতীত হইতে বর্তমান হইয়া ভবিষ্যতের দিকে ধায়। ইহাই সময়ের গতিপথ হিসাবে চিহ্নিত হয়। বিজ্ঞানে ইহা এক দুর্লঙ্ঘ্য নিয়ম। এই নিয়মের কোনও ব্যত্যয় ব্রহ্মাণ্ডে লক্ষ করা যায় না। অতীত মানুষের অভিজ্ঞতায় থাকে। সুতরাং, অতীত জানা। ভবিষ্যৎ তাহা নহে। তাহা অনিশ্চয়তায় ভরা, সেই কারণে রহস্যের অবগুণ্ঠনে আবৃত। এক জন মানুষের ক্ষেত্রে ইহা ঠিক হইতে পারে, ব্যক্তিবিশেষ তাহার অতীত বলিতে পারে, কিন্তু সমষ্টিগত ভাবে ইহা সত্য নহে। সত্য হইলে, ইতিহাস লইয়া এত বিতর্ক থাকিত না। ইতিহাস অতীতের উপরে আলোকপাত। আসল কথা এই যে, অতীত খনন করিতে হয়, এবং খননকার্যে সর্বদা একই ইতিহাস পাওয়া যায় না। ইতিহাস সম্পর্কে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায় না। সর্বজনগ্রাহ্য অতীত খনন করিতে গেলে নানা দিকে গবেষণা প্রয়োজন। ইতিহাসের জ্ঞান অন্বেষণে জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাও কখনওসখনও কাজে লাগিয়া যায়। সম্প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা ইতিহাস গবেষণায় ফলপ্রসূ হইয়াছে।
ইতিহাসের যে তথ্য আহরণ করিতে জ্যোতির্বিজ্ঞান কাজে লাগিয়াছে, তাহা মিশর সংক্রান্ত। মিশরের পিরামিড এবং মন্দিরগুলি তৎকালে আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জ বা সৌরমণ্ডলে গ্রহগুলির অবস্থানের দিকনির্ণয় অনুযায়ী নির্মিত কি না, তাহা বহুকালের বির্তক। সম্প্রতি সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়াছে। জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রমাণ করিয়াছে, সত্যই উক্ত পিরামিড এবং মন্দিরগুলি দিকনির্ণয় অনুযায়ী তৈরি হইয়াছিল। ইংল্যান্ডে বোর্নমাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফ্যাবিয়ো সিলভা, ওয়েলস ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী বার্নডেট ব্র্যাডি এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়েস্টার্ন কেপ ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদ মিশেল লখনার উক্ত অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিয়াছিলেন। উহারা ওই অনুসন্ধানে রত আছেন প্রায় বারো বৎসরকাল। প্রথমে ২০০৯ সালে সিলভা মিশরে ৩৩০টি মন্দিরকে সাতটি তালিকায় বিভক্ত করেন। মন্দিরগুলির দ্বার একই দিকে নহে। সিলভা মন্দিরগুলির বিভাজনের সময় দ্বার লক্ষ করেন, এবং বিশেষ দিকে দ্বার যে মন্দিরগুলির, সেইগুলিকে এক তালিকাভুক্ত করেন। পিরামিডের ক্ষেত্রে শুধু দ্বার নহে, মমিগুলি যে দিক বরাবর শায়িত আছে, তাহাও লক্ষ করিয়া পিরামিডগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেন। মিশরীয়গণ সূর্যদেবতাকে ‘রা’ নামে অভিহিত করিয়াছিল। এই রা দেবতার উপাসনা যে সব মন্দিরে হইত, সেই সব মন্দির এমন দিকনির্দেশ করিয়া নির্মিত হইত, যাহাতে প্রত্যক্ষে সূর্য উদয়কালে রৌদ্র মন্দির দ্বারে প্রবেশ করে। ইহাতে বিস্ময় নাই। বিস্ময়কর হইল মন্দির এবং পিরামিডগুলির ক্ষেত্রে রাত্রির আকাশে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান বিচার করিয়া স্থাপত্য নির্মাণ। সিলভা, ব্র্যাডি এবং লখনার এই উপসংহারে পৌঁছিয়াছেন যে, প্রাচীন মিশরীয়গণ রাত্রির আকাশ পর্যবেক্ষণে পটু ছিলেন।
মিশরে মন্দির বা পিরামিডের ব্যাপারে অতীত খনন সম্ভব হইলেও স্পেন দেশে এক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার সম্পর্কে তাহা সম্ভব হয় নাই। মাদ্রিদ শহরের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে হিউম্যানজস নামক স্থানে একশোটি পুরাতন কবরের সন্ধান মিলিয়াছে। তন্মধ্যে একত্রিশ নম্বর কবরটি অদ্ভুত। বছর পনেরোর একটি বালক বসা-অবস্থায় উক্ত কবরটির মধ্যে বিরাজমান। মানুষের অস্থিতে কার্বন পরমাণুর বিশেষ রকমফের উপস্থিত থাকে, যাহা তেজস্ক্রিয়। অর্থাৎ, তাহা সময়ের সহিত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ক্ষয়ের পরিমাণ দেখিয়া অস্থি বা ওই ধরনের কত পুরাতন, তাহা নির্ণয় করা হয়। এই রেডিয়োকার্বন ডেটিং পদ্ধতির সাহায্যে কবরটি যে ৩,৭০০ বৎসরের পুরাতন, তাহা নির্ণয় করা হইয়াছে। তাহা হউক, এক শত কবরের মধ্যে মাত্র ওই একটি কবরেই বালকটি বসা অবস্থায় কেন? কবর রচিত হয় মৃতদেহ শয়ান অবস্থায়। ধন্দে পড়েন আবিষ্কর্তা প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতা মাদ্রিদে কমপ্লুটেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আনা হেরোরো-কোরাল। রেডিয়োকার্বন ডেটিং পদ্ধতির সাহায্যে বালকের অস্থিতে বিদ্যমান নানা মৌলের পরিমাণ হইতে জানা গিয়াছে, মরিবার আগে বালকটি অপুষ্টিতে ভুগিতেছিল। আবার, কবরের মধ্যে প্রস্তর-নির্মিত একটি বর্শাফলক পাওয়া গিয়াছে। প্রশ্ন হইল, উক্ত বর্শাফলকের সাহায্যে বালকটিকে হত্যা করিলে, বালকটির দেহে আঘাতের চিহ্ন থাকিবে। তাহা নাই। হয়তো কোনও দিন কোনও নূতন পদ্ধতিতে জানা যাইবে, কী ইহার উত্তর। অতীতের প্রশ্ন এই ভাবেই বর্তমানকে তাড়া করিয়া বেড়ায়। মানুষের পক্ষেই সম্ভব, নিত্যনূতন পদ্ধতিতে উত্তরের সন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া।