ছবি: রয়টার্স।
সারা বিশ্বের নজর যখন গাজ়ায়, হামাস ও ইজ়রায়েলের যুদ্ধের জেরে ক্রমবর্ধমান দুর্বিপাকের দিকে, তখন বিশ্বের আর এক প্রান্তে আরও এক জনগোষ্ঠী মানবিক সঙ্কটের মুখে। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে পাকিস্তান সরকারের সব অনথিভুক্ত আফগানকে সে দেশ ছাড়ার নির্দেশ লক্ষ লক্ষ আফগান শরণার্থীকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই জনগোষ্ঠী বেশ কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানবাসী। সত্তরের দশকের শেষে সোভিয়েট ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করার পরে সে দেশের বহু বাসিন্দা চলে আসেন পাশের দেশটিতে। এঁদের অনেকেই কয়েক প্রজন্ম ধরে পাকিস্তানে বসবাস করলেও বৈধ নাগরিকত্ব পাননি। অভিযোগ, পাকিস্তানের জটিল প্রশাসনিক এবং আইনি প্রক্রিয়ার কারণেই তা সম্ভবপর হয়নি। পরিসংখ্যান-মতে, সেখানে প্রায় চল্লিশ লক্ষ আফগান বাস করেন, যার মধ্যে প্রায় ১৭ লক্ষ আফগানকে অবৈধ শরণার্থী হিসাবে গণ্য করছে পাক সরকার। ২০২১ সালে তালিবানরা যখন পুনরায় আফগানিস্তান দখল করে, তখনও অন্তত ৬ থেকে ৮ লক্ষ আফগান পালিয়ে আসেন পাকিস্তানে।
কেন হঠাৎ পাকিস্তান সরকারের এই নির্দেশ? তাদের মতে, মূলত অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণেই এই সিদ্ধান্ত। আফগানদের বিরুদ্ধে উঠছে লুটতরাজ, মাদক পাচারের মতো সংগঠিত অপরাধ এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ। এক সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ বছর এখনও পর্যন্ত সেখানে যে চব্বিশটি আত্মঘাতী হামলা হয়, তার চোদ্দোটিতেই যুক্ত ছিলেন এই অবৈধ শরণার্থীরা। পাকিস্তানের দাবি, ও দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলার নেপথ্যে রয়েছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান-এর মতো জঙ্গিগোষ্ঠী, যাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে আসছে পড়শি রাষ্ট্রের তালিবান সরকার। এবং এই কারণে দু’দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে উঠছে। অভিযোগ, পাক জনগণের চাকরি ‘চুরি’
করছে আফগানরা। তাদের আশা, প্রায় কুড়ি লক্ষ আফগান নির্বাসিত হলে, দেশে বেকারত্ব যেমন হ্রাস পাবে, তেমনই ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি।
অন্য দিকে, আফগানিস্তানের আর্থিক অবস্থাও তথৈবচ, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই অবস্থায় এত মানুষ সে দেশে ফিরে গেলে সকলের অন্ন ও কর্মসংস্থান জুটবে কি না, সন্দেহ। তা ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এখনও তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি আন্তর্জাতিক মহল। তাই রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে শুরু করে বহু মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলি পাকিস্তানকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছে। পাকিস্তান এখনও তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। তা ছাড়া, আগামী ফেব্রুয়ারিতে সেখানে সাধারণ নির্বাচন। আপাতত তদারকি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশটিতে আফগান বিতাড়নের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে হয়তো পাক সেনাবাহিনী। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে তালিবান যখন আফগানিস্তানে ফের ক্ষমতা দখল করে, তখন সেটা মূলত পাক সামরিক জয় হিসাবে দেখা হয়েছিল। আর এখন, আফগানদের মাধ্যমে তালিবান সরকারের উপরে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। এই দ্বৈরথেরই বলি আফগান শরণার্থীরা, ‘আমরা হাঁটতে থাকি, হেঁটে যেতে থাকি, এক দেশ থেকে অন্য দেশে’— আজ এই যাঁদের ভবিতব্য।