আজিকার যুগে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রেরা নাই, থাকিলে হয়তো তাঁহাদের শূলে চড়ানো হইত! তাঁহাদের উপন্যাসগুলি যতই জীবনবোধ-প্রসারী, আত্ম ও সমাজের নিহিত সঙ্কট-সন্ধানী হউক— বেআইনি লেখা বলিয়া তাঁহাদের হাতে হয়তো হাতকড়া পড়িত। নর-নারীর সম্পর্কে বিবাহই যে শেষ কথা, এবং চূড়ান্ত নির্ধারক শর্ত, এই নীতিপথে চলিলে কেবল বাংলা সাহিত্য কেন, বিশ্বময় শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি, সবেরই পরিসর হইত অতীব সঙ্কীর্ণ, রং হইত নিতান্ত ফ্যাকাশে, আর মান হইত ধর্মপুস্তিকা কিংবা আইনপুস্তিকার গোত্রভুক্ত। বিবাহিত নগেন্দ্র ও বালবিধবা কুন্দের প্রেমসম্পর্ক ঘনাইয়া উঠিতে পারিত না। মহেন্দ্র-আশালতার সংসারে বিনোদিনী আসিয়া পড়িয়া সম্পর্কের সমীকরণগুলি পাল্টাইয়া দিতে পারিত না। স্বামী মহিমকে ছাড়িয়া সুরেশের সহিত অচলা পশ্চিমে গিয়া এক সঙ্গে থাকিতে পারিত না। সন্দীপের তেজিয়ান দেশপ্রেমে, পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্বে কি আকৃষ্ট হইতে পারিত বিমলাও?
বিবাহ— এই সামাজিক, এবং রাষ্ট্রিক, প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরিয়া ঘুরিতে থাকে মানব-সম্পর্কের বিচিত্র পরিণতি, বিবিধ পরিস্থিতি। সমাজ ও রাষ্ট্র তাহাদের নিজ প্রয়োজনে তাহাকে ‘শেষ কথা’ বলে, আর মানবনিয়তি কিংবা দুর্নিয়তি তাহার পরও ‘কথা’ চালাইয়া যায়। তখন রাষ্ট্র ও সমাজের যুগপৎ শত্রু হইয়া দাঁড়ায় একাকী মানুষ। যুগের পর যুগ ধরিয়া এই যে অন্তর-বাহিরের লীলাভূিম, একবিংশ শতকে আসিয়াও সেই কঠিন কঠোর দ্বৈততা হইতে মুক্তির জানলা মেলে নাই। ইলাহাবাদ হাই কোর্ট ও রাজস্থান হাই কোর্ট সম্প্রতি জানাইল, নর-নারীর লিভ-ইন সম্পর্ক বৈধ হইলেও, তাঁহাদের এক জনও যদি বিবাহিত হন, তবে তাহা অবৈধ, বেআইনি। এক বিবাহিত মহিলা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া, গৃহ ছাড়িয়া আসিয়া অন্য এক যুবকের সহিত বাস করিতেছিলেন— আদালত বলিয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ অবৈধ। বৈধ কেবল— চরম নির্যাতনকারী শ্বশুরগৃহে ওই মেয়েটির বসবাস।
এত দিনে জানা হইয়াছে, বাহিরের প্রয়োজনেই নির্মিত বিবাহ প্রতিষ্ঠানটি। অন্তর বা অন্দরের কথা শুনিবার দায়টি তাহার নাই, কোনও কালেই ছিল না। ব্যক্তি-মুক্তির ধারক-বাহকরা তাই বলিতে পারেন, মানব-মানবীর অধিকার কত দূর এই প্রতিষ্ঠান দ্বারা সীমিত ও নির্ধারিত, সেই সব প্রশ্ন নাহয় উঠিলই এত দিনে। নাহয় ভাবিতেই বসা গেল যে, বিবাহিত হইলেই শরীর-মনের একমুখিতা অবধারিত এবং একমাত্র নিয়তি কি না। আইন বিবাহের পাশে থাকিলেও, মন যে থাকিবেই, তাহার নিশ্চয়তা আছে কি না। আর মন যদি না-ই থাকে, তাহা হইলে সেই বিবাহের প্রাতিষ্ঠানিকতাই একমাত্র সত্য কি না। সমাজের রীতি যাহা, তাহাই নীতি কি না। আবার সমাজের নীতি যাহা, তাহাই আইন কি না। প্রতিটি বিবাহিত সম্পর্কের অন্দরমহলের রোজনামচা বিচার অসম্ভব। কিন্তু কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ততায় আস্থা রাখাও কি একমাত্র পথ? কেহ বলিবেন, তাহা কেন, বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার তো স্বীকৃত। কিন্তু বিচ্ছেদের অধিকার অবধি পৌঁছাইবার উপযুক্ত বাস্তবও তো কত মানুষের ক্ষেত্রে নাই। সকলের জন্য একটি সাধারণ বিধি ও আইনের শাসন ছাড়া সমাজ চলিতে পারে না, কিন্তু সকলের জন্য মানবিকতাও কি বিধি বা আইনের আরাধ্য নহে? ভাবনার বিষয়।