মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, রাজ্যের অন্য শহরগুলিকেও কলিকাতার ন্যায় ‘ঝকঝকে, চকচকে’ করিয়া তুলিতে হইবে। শহর কলিকাতাও আদৌ মুখ্যমন্ত্রী-বর্ণিত ঝকঝকে শহর কি না, তাহা লইয়া তর্ক চলিতে পারে। বৃষ্টি না হইতেই যে শহর ভাসিয়া যায়; যেখানে ফুটপাত উপচাইয়া পড়ে বেআইনি হকারে, এবং রাস্তায় গাড়ি চলিবার জায়গা নামমাত্র; যে শহরে অতি বিপজ্জনক ভগ্নপ্রায় বাড়ির সমস্যার সমাধান কিছুতেই হইয়া উঠে না— তেমন শহরকে নগরায়ণের আদর্শ হিসাবে গণ্য করা আদৌ বিধেয় কি না, সেই প্রশ্নও উঠিতে পারে। কিন্তু, কলিকাতা ভিন্ন রাজ্যে আর কোনও জাতীয় মানের নগরাঞ্চল নাই, এই পরিস্থিতিটি যে পাল্টানো প্রয়োজন, সেই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সহিত একমত হইতেই হয়। পশ্চিমবঙ্গ কেন কার্যত এক শহরবিশিষ্ট রাজ্য, এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করিলে ইতিহাসের দিকে তাকাইতে হয়। দেশের রাজধানী হইবার সুবাদে শহরটি এমনই গুরুত্বপূর্ণ হইয়াছিল যে, বাংলার যাবতীয় অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্য বা শিক্ষাসংক্রান্ত উন্নয়ন, সবই হইয়াছিল কলিকাতাকে কেন্দ্র করিয়াই। এমনকি, বঙ্গের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকাও কলিকাতার উন্নতির সহিত পাল্লা দিতে পারে নাই। প্রদেশের অন্য বর্ধিষ্ণু জনপদগুলি রক্তাল্পতায় ভুগিয়া শুকাইয়া গিয়াছে। রাজধানী দিল্লিতে সরিয়া গিয়াছে, কলিকাতা হইতে একে একে বিদায় লইয়াছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির সদর দফতর, কিন্তু রাজ্যের কলকাতামুখিনতার অভ্যাস পাল্টায় নাই। বিধানচন্দ্র রায় চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, তাঁহার সেই চেষ্টাও মূলত ব্যর্থ হইয়াছে।
বিধান রায়ের উদ্যোগ কল্যাণী কেন সম্পূর্ণ মুখ থুবড়াইয়া পড়িল, অথচ দুর্গাপুর টিকিয়া গেল, কলিকাতার তুল্য না হইতে পারিলেও কেন উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি তাহার গুরুত্ব বজায় রাখিতে পারিল, এই প্রশ্নগুলির উত্তর আছে অর্থনীতির ভাঁজে। শিলিগুড়ি সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার, ফলে তাহার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অসীম। কিন্তু, সেই গুরুত্ব মূলত বাণিজ্যের পথ হিসাবে, শিল্পের কেন্দ্র হিসাবে নহে। ফলে, তাহার সীমাবদ্ধতা আছে। দুর্গাপুর গড়িয়া উঠিয়াছিল শিল্পাঞ্চলকে কেন্দ্র করিয়া, কিন্তু কল্যাণীর সেই আর্থিক ভিত্তি ছিল না। অর্থাৎ, শহর গড়িয়া তুলিলেও তাহা চকচকে-ঝকঝকে হইয়া উঠিবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করিতেছে মূলত সেই শহরকে কেন্দ্র করিয়া চলা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর। রাজ্যে যদি কলিকাতার মানের একাধিক নগরাঞ্চল গড়িয়া তুলিতে হয়, তাহার জন্য অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি ফিরাইতে হইবে।
অজ গ্রাম হইতে কী ভাবে একটি বিশ্বমানের শহর গড়িয়া উঠিতে পারে, তাহার উদাহরণ মাত্র চার ঘণ্টার বিমান দূরত্বে আছে— সিঙ্গাপুর। গত শতকের ষাটের দশক অবধিও তাহা ছিল মূলত মৎস্যজীবীদের বাসস্থান। এক শহরের দেশ, দ্বীপরাষ্ট্র— ফলে, শিল্পায়নের সম্ভাবনা ছিল সীমিত। সিঙ্গাপুর নিজেকে গড়িয়া তুলিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে। এশিয়ার তো বটেই, ইউরোপ আমেরিকার বহু বৃহদায়তন বাণিজ্যিক সংস্থা তাহাদের প্রধান কেন্দ্রটিকে সরাইয়া আনিল সিঙ্গাপুরে। তাহার জন্য নাগরিক পরিষেবাকে বিশ্বমানের করিতে হইয়াছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাইতে হইয়াছে। উদাহরণটি স্মরণীয়। রাজ্যে যদি সত্যই একাধিক বৃহৎ নাগরিক কেন্দ্র গড়িয়া তুলিতে হয়, তবে বাহ্যিক সৌন্দর্যায়নে নহে, জোর দিতে হইবে নাগরিক পরিকাঠামো গঠনের উপর। বাহ্যিক এবং মানবসম্পদ পরিকাঠামো, উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। ভাবিতে হইবে, অর্থনীতির কোন ধারাটি এই রাজ্যে সর্বাপেক্ষা সহজে প্রবহমান হইতে পারে। সরকার এই পরিকল্পনাটি সুষ্ঠু ভাবে করিতে পারিলে শহর আপনা হইতেই ঝকঝকে-চকচকে হইবে, তাহার জন্য আলাদা করিয়া ভাবিতে হইবে না।