Stagnant Water

জলতলে

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দফায় দফায় অতিবৃষ্টি আজ প্রত্যাশিত। ভারতের মহানগরগুলিতে তাহার প্রস্তুতি শূন্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:৪০
Share:

যন্ত্রণা না হইলে যেমন দাঁতের কথা স্মরণ হয় না, তেমনই জল না জমিলে নিকাশিব্যবস্থার কথা সকলে ভুলিয়া থাকে। প্রতি বৎসর বর্ষায় জলবন্দি শহরে নিকাশির দুর্দশা লইয়া শোরগোল উঠে, জল নামিলেই কলরব থামিয়া যায়। কিন্তু ভুলিবার মতো বিষয় ইহা নহে। রাজ্যের অর্থনীতি কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে যথাযথ নিকাশির অভাবে, তাহার একটি মূল্যায়ন এই বার প্রয়োজন। তাহাতে রাখিতে হইবে বহু লক্ষ হেক্টর কৃষিজমির দীর্ঘ জলমগ্নতার কারণে ফসল নষ্ট হইবার আর্থিক পরিমাপ, এবং তাহার ক্ষতিপূরণস্বরূপ রাজকোষ হইতে কৃষকদের বিতরিত অর্থের অঙ্ক। থাকিবে বিভিন্ন গুদাম, বাজার প্রভৃতিতে জল ঢুকিবার জন্য বিনষ্ট সামগ্রীর মূল্য। জেলা শহর ও মহানগরের বাণিজ্যিক এলাকাগুলি জলবন্দি হইবার জন্য নষ্ট কর্মদিবস এবং আর্থিক ক্ষতির খতিয়ান। জমা জলে দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের সংখ্যাও জানিতে হইবে। রাখিতে হইবে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিও, প্রতি বারই জলমগ্ন শহর-গ্রামে যাহার প্রাদুর্ভাব হয়, এবং প্রাণ লইয়া যায়। এই হিসাব কঠিন, এমনকি অসম্ভব মনে হইতে পারে— রাস্তা জলপূর্ণ থাকিলে, দফতর, দোকান, বসতবাড়িতে জল ঢুকিলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কত বিচিত্র ভাবেই না ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাহার পূর্ণ বিবরণ কি সম্ভব? অবশ্যই নহে, কিন্তু অতি অসম্পূর্ণ বিবরণও আর্থিকসম্পদ ও মানবসম্পদের ক্ষতির অতিকায় একটি অঙ্ক সম্মুখে আনিবে, সন্দেহ নাই। ওই অঙ্কটিই নিকাশিকে অবহেলা করিবার মূল্য।

Advertisement

এই অবহেলা এই রাজ্যের উত্তরাধিকার— বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনার ত্রুটিতে নিকাশি উত্তরোত্তর ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। বাঁধ নির্মাণের ফলে পলি জমিয়া নদীখাত উঁচু এবং তীরবর্তী জনপদগুলি নিচু হইয়াছে। আজ অতিবর্ষণে নদীর জল কূল ছাপাইয়া আসিলে জনপদগুলিকে অপেক্ষায় থাকিতে হয়, কখন স্ফীত নদীর জল কমিবে। সরকার নদী সংস্কারের প্রকল্প গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু বরাদ্দ টাকা যত দ্রুত সরিয়াছে, বন্যার জল তত দ্রুত নহে। নদী সংস্কার কাজটিতেই দুর্নীতির দুর্গন্ধ লাগিয়াছে। শহর ও গ্রামে স্থানীয় প্রশাসনও আপন এলাকার প্রাকৃতিক নিকাশিব্যবস্থাকে অবহেলা করিয়াছে। ছোট নদী, নালা, নয়ানজুলি রক্ষণাবেক্ষণ করে নাই। প্রায় বাধাহীন ভাবে সেইগুলি বেদখল হইয়াছে, সেইগুলির উপর নির্মাণ হইয়াছে, বহু জলপথের আর চিহ্নমাত্র নাই। বিভিন্ন জনপদ হইতে জল নিকাশির যে লকগেটগুলি আছে, বহু ক্ষেত্রে সেইগুলি বিকল— ফলে খালের জল পাল্টা লোকালয়ে ঢুকিতেছে। সর্বোপরি আসিয়াছে প্লাস্টিক। সরকার তাহার ব্যবহারে লাগাম দেয় নাই, নাগরিকও হিতাহিত বোধশূন্য হইয়া ব্যবহৃত প্লাস্টিকে ভরাইয়া তুলিয়াছে নিকাশি নালা। এমন অপরিণামদর্শিতার ফলে যাহা হইবার, তাহাই ঘটিয়াছে— নিকাশিব্যবস্থা আজ জল বহিতে অক্ষম। কলিকাতা মহানগরীর দীর্ঘ জলমগ্নতা তাহার দৃষ্টান্ত।

অথচ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দফায় দফায় অতিবৃষ্টি আজ প্রত্যাশিত। ভারতের মহানগরগুলিতে তাহার প্রস্তুতি শূন্য। আজ প্রয়োজন নিকাশির একটি সুসংহত এবং সক্রিয় ব্যবস্থা নির্মাণের। সেচ ও জলপরিবহণ, ভূমি ও ভূমিসংস্কার, এবং মৎস্য দফতরের সহিত পুরসভা ও পঞ্চায়েতব্যবস্থার সমন্বয়ের অভাবে নদী সংস্কার ব্যাহত হইতেছে। প্রয়োজনে এই সকল দফতরের আধিকারিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধি, এবং তৎসহ জলসম্পদ, পরিবেশ, কৃষি প্রভৃতি সকল সংশ্লিষ্ট দফতর হইতে প্রতিনিধি লইয়া একটি পৃথক সংস্থা গঠন করিতে হইবে। ওই সংস্থা যাহাতে নিকাশিব্যবস্থার সংস্কারের প্রকল্পগুলি দ্রুত রূপায়ণ করিতে পারে, অনুমোদনের অপেক্ষায় দিন না কাটিয়া যায়, তাহা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বহু কাজ অসম্পূর্ণ, বহু নূতন পরিকল্পনা লইতে হইবে। নিকাশির সংস্কারে বিলম্বের মূল্য বড়ই অধিক। নগর কলিকাতা সেই মূল্য চুকাইয়াই চলিতেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement