আইন আইনের পথে চলিবে— এই বহুলপরিচিত বাণীর একটি তির্যক সম্প্রসারণও নিতান্ত অপরিচিত নহে: আইন আইনের পথে চলিবে, রাজনীতি রাজনীতির পথে। অর্থাৎ, রাজনীতি চলিবে আইনের তোয়াক্কা না করিয়া। তবে ইদানীং এই দেশের রাজনীতি এবং আইনের চালচলন যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে এই ব্যঙ্গকেও নিতান্তই বিস্বাদ এবং অচল বলিয়া বোধ হইতে পারে। এক দিকে, ‘আইনের পথ’ বলিয়া আদৌ আর কিছু অবশিষ্ট আছে, না রাজনীতি তাহাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করিয়া লইয়াছে, তাহাই এখন বড় প্রশ্ন। আবার অন্য দিকে, রাজনীতির নিজস্ব পথটিতেও আইন আজ আর কোনও বাহিরের ব্যাপার নহে, সেই পথ কাটিবার অন্যতম প্রকরণ— রাজনীতি প্রতিনিয়ত আইনি ব্যবস্থাটিকে আপন স্বার্থে ব্যবহার করিয়া চলিয়াছে। কোনটি আইনের পথ, কোনটিই বা রাজনীতির পথ, তাহাই বর্তমান ভারতে এক বিরাট প্রহেলিকা।
পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করিয়া সেই প্রহেলিকার নূতন নূতন পর্ব উন্মোচিত হইয়া চলিতেছে। বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে তাহার এক রূপ দেখা গিয়াছিল। নির্বাচনের পরে শুরু হইয়াছে নূতন ধারাবাহিক রহস্য রোমাঞ্চ উপাখ্যান। আপাতদৃষ্টিতে যাহা ঘটিতেছে, সকলই আইনের পথে। কিন্তু তাহার পদে পদে নানা প্রশ্ন উঠিতেছে, যাহাদের সদুত্তর সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। যেমন, যে দুর্নীতির ‘দৃশ্যমান’ অভিযোগের পরিণতিতে রাজ্যের শাসক দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা সম্প্রতি তৎপর হইলেন, তাহার অনুরূপ ভিডিয়ো-চিত্রে দৃশ্যমান হইয়াও তেমন কোনও তৎপরতার শিকার হইলেন না অন্য কোনও কোনও নেতা, যাঁহারা ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় শাসক দলের খাতায় নাম লিখাইয়াছেন! এক যাত্রায় পৃথক ফল হইতেই পারে, কিন্তু দল-বদলের অঙ্কের সহিত তাহা এমন খাপে খাপে মিলিয়া গেলে সংশয় স্বাভাবিক নহে কি? অধুনা আবার রাজ্যের শাসক দলের সাংসদ এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে লইয়া কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের তৎপরতা প্রকট হইয়াছে। আইন মোতাবেক তদন্ত নিশ্চয়ই হইতে পারে, কিন্তু অতীতের মতোই এখনও প্রশ্ন উঠিতে পারে: যে তদন্ত স্বাভাবিক গতিতে চলিতে পারিত, তাহা কেন এমন থাকিয়া থাকিয়া, জোয়ার-ভাটার মতো ওঠানামা করে? কোন অলখ টানে অনুসন্ধান এমন তরঙ্গায়িত হয়? জনগণের মনে যদি প্রশ্ন উঠে, ‘তদন্ত অভিযান’ কতখানি প্রকৃত অনুসন্ধান আর কতখানিই বা নাটক, তাহাকে ভিত্তিহীন বলা যায় না।
এই প্রহেলিকাই ছায়া ফেলে রাজনীতির পরিসরেও। তদন্তের প্রক্রিয়া ও জিজ্ঞাসাবাদ হইতে উঠিয়া আসা বিবিধ সংবাদ ও বিবিধতর সংশয়— সমস্তই রাজনৈতিক তরজার উপকরণ হইয়া দাঁড়ায়, তদন্তকারীদের ডাকে রওনা দিবার পূর্বে এবং দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের শেষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়া রাজনীতিক আপনার দলীয় অবস্থান ঘোষণা করিতে থাকেন। রাজনৈতিক ভাষণের আঁচ এবং রাজনৈতিক বিরোধিতার প্রকৃত তাগিদ, এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক সম্ভব। নাগরিকের মনে সংশয় থাকিতেই পারে— এই সকল ‘লড়াই’-এর কতটা প্রকৃত রাজনৈতিক দ্বৈরথ? নির্বাচন কমিশন যে ভাবে রাজ্যের একটি কেন্দ্রে উপনির্বাচনের জন্য ‘ব্যতিক্রমী’ নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে, তাহাও এমন সংশয় উস্কাইয়া দেয়। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে রাজ্যের শাসক দলের ভূমিকা কী হইবে, বিরোধী ঐক্যের ক্ষেত্রে তাহারা ঠিক কী অবস্থান লইবে, কংগ্রেসের মতো দল, রাজ্য রাজনীতিতে যাহাদের (কিঞ্চিৎ) ভূমিকা আছে, তাহারাই বা কী ভাবে আপন গতিপথ স্থির করিবে, তাহা লইয়াও নানা প্রশ্ন আছে। সেই সকল প্রশ্ন কি দুর্নীতির ‘তদন্ত’ প্রক্রিয়ার সহিত জড়াইয়া যাইতেছে? এই জটিল আবর্তে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি যে কোথায় হারাইয়া যায়, দেবা ন জানন্তি।