আর এক মাস পরেই শারদীয় উৎসবের সূচনা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, কোভিড অতিমারির তৃতীয় প্রবাহও তখনই শিখরে পৌঁছাইবে। আমেরিকা ইতিমধ্যেই সেই তৃতীয় প্রবাহ প্রত্যক্ষ করিতেছে— প্রাত্যহিক আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লক্ষ অতিক্রম করিয়া গিয়াছে। সেই দেশে অবশ্য অতিমারির পালে উৎসবের বাতাস লাগে নাই— স্কুল খুলিয়া দেওয়ায় অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে বিপজ্জনক বেগে সংক্রমণ ছড়াইয়া পড়িয়াছে। অন্য দিকে, একটি উৎসব কী ভাবে অতিমারির পরিস্থিতিকে গুরুতর করিয়া তুলিতে পারে, তাহার মোক্ষম প্রমাণ কেরল। যে রাজ্যটি কোভিড সামলাইবার কাজে শুধু দেশেই নহে, আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পাইয়াছে, এই বৎসরের ওনাম উৎসব তাহাকে ফের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন করিল। ঘটনা হইল, উৎসবের গণচরিত্রে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গোৎসব গোটা দেশে অতুলনীয়। বিশেষত, কলিকাতা শহরে বারোয়ারি পূজাকে কেন্দ্র করিয়া যে গণবিস্ফোরণ ঘটে, তাহা কোভিডের তৃতীয় প্রবাহের সুপার স্প্রেডারের ভূমিকা লইতে পারে। গত দেড় বৎসরে অতিমারির অভিজ্ঞতা একটি কথা শিখাইয়াছে— এক বার তাহা শক্তিশালী হইয়া উঠিলে সেই ধ্বংসলীলা থামাইবার সাধ্য মানুষের নাই। এই রাজ্যে অতিমারির দ্বিতীয় প্রবাহটি ডাকিয়া আনিয়াছিল বিধানসভা নির্বাচন— নেতাদের রাজ্য-দখলের তাড়নার মূল্য চুকাইতে হইয়াছিল মানুষকে। এই বার উৎসবের ফাঁক গলিয়া যেন ফের বিপদ না ঢুকিয়া পড়ে, তাহা নিশ্চিত করিতেই হইবে।
উদ্বেগজনক ভাবে, পূজা যাহাতে সুপার স্প্রেডার না হইয়া উঠিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করিবার যথেষ্ট উদ্যোগ এখনও দেখা যাইতেছে না। পূজার আয়োজন সর্বাধিক কোন মাপের হইতে পারে, দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কী কী বাধানিষেধ মানিয়া চলিতেই হইবে, সরকারের তরফে এখনও অবধি সেই বিষয়ে কোনও স্পষ্ট নির্দেশ নাই। গত বৎসর আদালতের হস্তক্ষেপের ফলে এই নিয়ন্ত্রণের কাজটি বহু দূর অবধি হইয়াছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘিত হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম ছিল। সেই সচেতনতার সুফলও পাইয়াছিল পশ্চিমবঙ্গ। পূজার পরে সংক্রমণের হার বাড়ে নাই, বরং ধীরে ধীরে কমিয়াছিল। এই বৎসরও সেই পথে হাঁটাই বিধেয়। পূজা কমিটি, থানা ও স্থানীয় প্রশাসনের জন্য স্পষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করা প্রয়োজন— এবং, নির্দেশ অমান্য করিলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করাই বিধেয়। কয়েক দিনের আনন্দ যাহাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ না হইয়া দাঁড়ায়, তাহা নিশ্চিত করা প্রশাসনের কর্তব্য। তাহার জন্য আদালতের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকিলে দুর্ভাগ্যজনক হইবে।
সরকার যদি পূজার আনন্দে নির্দেশিকার লাগাম পরাইতে অনিচ্ছুক হইয়া থাকে, তবে তাহার কারণটি অজ্ঞাত নহে— নেতাদের আশঙ্কা, আনন্দে রাশ টানিলে মানুষ ক্ষুব্ধ হইবেন। ইহা সত্য যে, গড়পড়তা বাঙালি সারা বৎসর পূজার চার-পাঁচ দিনের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু, গত দেড় বৎসরের অভিজ্ঞতা হইতে মানুষও কি শিক্ষাগ্রহণ করে নাই? কোভিড বাড়িবার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া যে বিবিধ অর্থনৈতিক বাধানিষেধ, এবং তাহার ফলে অনেকের রুজিরুটির তীব্র সমস্যা সৃষ্টি হওয়া, এই কথাটি কি মানুষও জানে না? ফলে, সরকার পূজার আদর্শ আচরণবিধি প্রস্তুত করিলে তাহাকে অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলাই রাজ্যবাসীর কর্তব্য। নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব সচেতনতার প্রসারে অংশী হওয়া। কোভিড লইয়া নিরন্তর প্রচার চালাইয়া যাওয়া, গণমাধ্যমের পরিসরটিকে ব্যবহার করা। অতীত অভিজ্ঞতা শিখাইয়াছে যে, এই লড়াইয়ে কোনও মতেই হাল ছাড়িয়া দেওয়া চলিবে না। সতর্ক থাকাই বাঁচিবার পথ। তাহার জন্য আনন্দে ঘাটতি পড়িলে তাহা মানিয়া লওয়া কর্তব্য।