AI

উপকারী, কিন্তু নিরাপদ তো?

মোবাইলে ম্যাপ দেখে গন্তব্যে পৌঁছনো বা শারীরিক উপসর্গের তথ্য বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয়, ওষুধ তৈরির কাজ ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে তা কাজে লাগানো হচ্ছে।

Advertisement

সিদ্ধার্থ মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:১২
Share:

এআই-নির্ভর নানা যন্ত্র এখন ব্যবহৃত হচ্ছে তথ্য বিশ্লেষণ বা জটিল সমস্যা সমাধানের কাজে। এআই মুহূর্তে বিশাল তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণে সক্ষম। মোবাইলে ম্যাপ দেখে গন্তব্যে পৌঁছনো বা শারীরিক উপসর্গের তথ্য বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয়, ওষুধ তৈরির কাজ ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে তা কাজে লাগানো হচ্ছে। এ ছাড়াও, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ বা অণুজীববিজ্ঞানে প্রোটিন বা জিনের ক্রমপর্যায় বিশ্লেষণ করে জরুরি তথ্য দেওয়ার কাজেও তা কার্যকর। তবে, এআই-নির্ভর ফলাফল কতটা নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ সে প্রশ্নও উঠেছে।

Advertisement

এ বছর পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে নোবেলজয়ীদের গবেষণার কেন্দ্রে ছিল এআই। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা মানবমস্তিষ্কের নিউরন নেটওয়ার্ক অনুসরণে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেল উদ্ভাবন করেছেন। মানবমস্তিষ্কে পূর্ব-অভিজ্ঞতার স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে, দরকারে যা পুনরুদ্ধার করে, মস্তিষ্কে মজুত তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিজ্ঞানীদের দাবি, তাঁদের কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেল অনেকটা সে ভাবে কাজ করতে পারে।

মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত একক নিউরন বা স্নায়ুকোষ। এক-একটি নিউরনে প্রায় এক হাজার থেকে এক লক্ষ সংযোগসূত্র থাকে। মস্তিষ্কে জাল বিছিয়ে রাখা নিউরনগুলি একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে কাজ করে। সংযোগসূত্রগুলির মাধ্যমে তড়িৎ সংবহন প্রবাহ আদানপ্রদান হয় নিউরনে। মস্তিষ্কের বহু কাজ এই নিউরন নেটওয়ার্ক ব্যবস্থায় সম্পন্ন হয়। বিশ্লেষণ করা, পূর্বস্মৃতি মনে রাখা, গাণিতিক সমাধান বা পরিকল্পনার মতো কাজ করে স্নায়ুকোষেরা। স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির অজস্র তথ্য মস্তিষ্কে থেকে যায়। যখন আমরা কিছু মনে করতে চাই, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্থান থেকে স্নায়ুকোষের বৈদ্যুতিক সঙ্কেতপ্রবাহ তা মনে করায়। এই ধাঁচে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম নিউরাল নোড জুড়ে তৈরি করেছেন নিউরাল নেটওয়ার্ক। শিশুকে যে ভাবে অজানা বিষয় বারংবার শেখানো হয়, অনেকটা সেই ভাবে নানা তথ্য দেখিয়ে কম্পিউটারকে শেখানো হয় বার বার, যার পোশাকি নাম মেশিন লার্নিং। প্রশিক্ষিত কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে মুহূর্তে ঠিক উত্তর দিতে পারে, লক্ষ লক্ষ তথ্যের মধ্য থেকে অতি দ্রুত যথাযথ তথ্য খুঁজে দেয়।

Advertisement

মানবমস্তিষ্কে প্রতিনিয়ত একটু-একটু করে বদল হয়। নতুন নতুন সংযোগ স্থাপন হয়, অপ্রাসঙ্গিক সংযোগ বিলুপ্ত হয়ে চলে। নতুন অভিজ্ঞতার জ্ঞান সম্পৃক্ত হচ্ছে মস্তিষ্কে, জীবনের নানা পদক্ষেপে নানা ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে শিখছে। দৃশ্যকল্প নির্মাণপ্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের নানা অংশ একত্রে কাজ করে। মানবমস্তিষ্ক যে ভাবে নিরন্তর শিখতে থাকে, তার অনুকরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও যথার্থ কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা বস্তুত অসম্ভবই। এই নেটওয়ার্ক যে যথার্থ হবে না তার কারণ, মানবমস্তিষ্কের নিরন্তর বদল। মস্তিষ্ক তথা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের জটিল কার্যকলাপ ও অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করাও মুশকিল। কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলকে তাই মানবমস্তিষ্কের কার্যকর প্রতিরূপ বলে দাবি করাও চলে না।

প্রোটিন ডিজ়াইন ও প্রোটিন-স্ট্রাকচার অনুমান সংক্রান্ত কাজে রসায়নে নোবেল পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী। অ্যামাইনো অ্যাসিড সিকোয়েন্স থেকে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন অনুমান— যা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য কাজ, এআই-ব্যবহারে তাতে সাফল্য এসেছে। এ ক্ষেত্রেও মেশিন লার্নিং পন্থায় কম্পিউটারকে বুদ্ধিমান করা হয়েছে। যে তথ্যের ভিত্তিতে এআই পূর্বাভাস দিতে সক্ষম, তা গত পাঁচ দশক ধরে পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে নির্ণয় করে পাওয়া। প্রোটিন ডেটাব্যাঙ্কে গচ্ছিত, বিভিন্ন প্রোটিনের ক্রমপর্যায় ও গঠনের বিপুল তথ্য এআইকে চেনানোর কাজ করেছেন গবেষকরা। পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে যে কাজ করতে বছর গড়ায়, কয়েক সেকেন্ডেই তা করতে পারে এআই। এই পথেই মাত্র ক’বছরে প্রায় কুড়ি কোটি প্রোটিনের গঠনের অনুমান সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীদের দাবি, এআই ব্যবহার করে প্রোটিনের জটিল কাঠামোর পূর্বাভাসের ফলাফল অন্যান্য পরীক্ষামূলক নির্ণয়ের সমতুল্য না হলেও, প্রায় ৯০%।

প্রোটিনের সম্ভাব্য ত্রিমাত্রিক গঠনের পূর্বাভাস ও প্রোটিন ডিজ়াইনের কাজে ‘রোসেটাফোল্ড’ এআই-সফ্টওয়্যার ব্যবহৃত হয়েছে। পরে বিভিন্ন ক্রমপর্যায়ের অ্যামাইনো অ্যাসিডের ব্যবহারে তৈরি করা হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন এক প্রোটিন। এ ভাবে একের পর এক প্রোটিন সৃষ্টি করা হয়েছে, তার কোনওটি ওষুধ, ভ্যাকসিন বা ন্যানোমেটিরিয়াল বা ‘অতিক্ষুদ্র সেন্সর’ হিসেবে কাজ করতে পারার সম্ভাবনাযুক্ত। আগাম অনুমান করে প্রোটিনের এই গঠন ডিজ়াইন করতে পারা বিরাট সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে— চিকিৎসা, জৈবপ্রযুক্তি ও জৈবরসায়নে।

তবে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের যে আশঙ্কা, প্রোটিন গঠন অনুমানের ক্ষেত্রেও তা একই রকম সত্য। শুধু সীমাবদ্ধতাই নয়, অনিশ্চয়তা ও ফল ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও এড়ানো যাবে না। প্রোটিন গঠনের পূর্বাভাস নির্ণয়ে যে ১০ শতাংশ তফাত, তার ভিত্তিতে যদি নতুন প্রোটিন তৈরি করা হয়, তার কার্যকারিতা বা সম্ভাব্য ক্ষতিও নিশ্চিত বলা যায় না। এমন প্রোটিনের ব্যবহারও কি নিরাপদ? সেই প্রোটিন কোনও ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হলে তাতে কোনও বিপদাশঙ্কা থাকবে না, তা কি নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব? নতুন প্রোটিন তৈরির কাজে তাই সতর্কতা প্রয়োজন। এআই-জাত প্রোটিনের তথ্য যখন রোগ নির্ণয় বা নির্দিষ্ট ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হবে, সে ক্ষেত্রে অসফল পূর্বাভাস যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement